অনলাইন ডেস্ক : রোববার দুপুর ১টা ৫৮ মিনিট।
বনলতা সুইটসের সামনে এসে গাড়িটা থামতেই একগাদা পানি ছিটে এলো ফুটপাতে। ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ ভিজে গেলেন সেই কাদাপানির বর্ণচ্ছটায়। হজ ক্যাম্পে তার দুই আত্মীয় এসেছেন গ্রাম থেকে, হজে যাবেন তারা, সেখানে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন তিনি প্রায় এক ঘণ্টা যাবত। কোনো বাস নেই, যেতে চাচ্ছে না কোনো সিএনজি অটোরিকশাও, সবকিছু কেমন যেন গুমোট, থেমে আছে স্থির হয়ে। এরই মধ্যে উত্তরাগামী একটি বাস এসে থামল মিরপুর ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে। অনেকেই হুমড়ি খেয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন তাতে। কন্ডাক্টর পল্টনে ভাষণ দেওয়া নেতার মতো সগর্বে বলল, ‘বাস যাইব না। কিরমিটোলায় গ্যাঞ্জাম বাইধছে।’
গ্যাঞ্জাম শব্দটা শেষ পর্যন্ত এসে স্থির হলো- তিনজন ছাত্র মারা গেছে কুর্মিটোলায়, বাসচাপায়। শেষমেশ দু’জন। কথাটা শুনে সেই ঘিয়ে রঙা পাঞ্জাবি পরিহিত বৃদ্ধ চোখ দুটো ঈষৎ আকাশের দিকে তুলে শব্দ করে বললেন, ‘ইন্নালিল্লাহি…।’ বাক্যটা শেষ করে বিষাদ মুখে বললেন, ‘অভিশাপ’।
নিক জোনাসের দেওয়া আংটি শোভা পাচ্ছে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার অনামিকায়, রোনালদোর শরীরের গঠন ২০ বছরের যুবকের মতো, অন্য মেয়ের সঙ্গে জাস্টিন বিবারের বাগদান হওয়ায় বিয়েই করবেন না সেলেনা গোমেজ- এ খবরগুলো যত তাড়াতাড়ি আমরা জানতে পারি, পৌঁছে যায় সবার কানে কানে, মাত্র চার কিলোমিটার ফাঁকে দু-দুটি তাজা প্রাণ পিষে ফেলার খবর কেন আমরা খুব দ্রুত জানতে পারি না? কারণ সম্ভবত দুটি- এক. নিত্য ঘটে যাওয়া এই ধরনের খবরে আমাদের আর আগ্রহ নেই; দুই. এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা তিলে তিলে।
মায়ের হাত থেকে ছিটকে বাসের চাপায় মাথার খুলি ফাটা সেই স্কুল ছাত্রীর অন্তিম চিৎকার এখনও শুনতে পাই শেওড়াপাড়ার রাস্তায়। আরও একটু ভালো করে কান পাতলে শোনা যায় গুনগুনানো কান্নাও। রাস্তা বিভাজকে ওখানকার গাছগুলোকেও কেমন ম্লান দেখা যায় মাঝে মাঝে।
রাজীবের ডান হাতটা এখনও ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের আশপাশে। কখনও কখনও আমাদের চোখ বরাবর এসে থেমে রয় কিছুক্ষণ। আতঙ্কে থমকে যাই আমরা, কুঁকড়ে যাই ভয়ে। আমরা এটা তো জেনে গেছি- সজোরে কাউকে থাপ্পড় মারার জন্য ওটা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্লান্তিহীন।
আর হাসিমুখের পায়েল? দুর্ঘটনায় আহত ছেলেটাকে চিকিৎসা দেওয়ার বদলে পানিতে ফেলে দিল পরিবহনকর্মীরা! তার মায়ের করুণ আক্ষেপ- ‘অন্তত ওই অবস্থায় রাস্তায় রেখে গেলেও হয়তো ছেলেটা বেঁচে যেত।’ পানিতে ডুবতে ডুবতে পায়েল কি একবার আকাশে তাকিয়েছিল? সে কি কোনো নক্ষত্র দেখেছিল শেষবারের মতো? ভোরের জেগে ওঠা কোনো পাখির ডানা ঝাপটানো গান শুনছিল? কোনো জীবিতই কোনো মৃত্যুর স্বাদ বুঝতে পারে না। তবুও জানতে ইচ্ছে করে- ডুবে যেতে যেতে মরে যাওয়াটা কত যন্ত্রণাদায়ক, কতটুকু বাতাসহীন কলজে চেরা!
এবং আরও অনেক কিছু পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী।
কেন বার বার এসব হচ্ছে?
কার দোষে?
কার নিষ্ফ্ক্রিয়তায়?
কার অবহেলায়?
খুব জানতে ইচ্ছে করছে- ঠিক ওই মুহূর্তে কী করছিলেন আমাদের বিজ্ঞ পরিবহন নেতারা। ঘটনাটি শোনার পর তারা কী মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েছেন? সঙ্গে কীসের সালাদ ছিল? লেবু ছিল কি সঙ্গে? এসি রুমের এসিটা কততে চলছিল- ১৮ না ২২-এ? তারপর একটা নিশ্চিন্ত ভাতঘুম দেওয়ার পর বিবৃতিপ্রিয় নেতার মতো তারা কোন বিবৃতিটি দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন? সব মিডিয়াতে যা ছড়িয়ে পড়বে বানের জলের মতো।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে অনেকেই বলেন- মাতৃত্বের ছায়া, মমতাময়ী। এতক্ষণে তিনিও জেনে গেছেন ঘটনাটি। কেমন লেগেছে তার? কেমন কেঁপে উঠেছে তার মাতৃহৃদয়? দু-দুটি তরতাজা প্রাণ, কৈশোর পেরোনো স্বপ্নময় চোখ, জীবন সাজানোর অবিরাম মহড়ায় কাটানো দুটি ছেলেমেয়ে থেমে গেল হঠাৎ, চিরতরে! কষ্ট পেয়েছেন তিনি- নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। তারপর? সারি সারি বয়ে যাওয়া ট্রেনের চাকার মতো সারি সারি লাশ, একের পর এক, বিরামহীন এবং বিচারহীন!
এবার কি তিনি কিছু বলবেন? তার মা-মানসটা কি এবার থামিয়ে দেবে সব অনাচার? তারপর আমরা আমাদের আনন্দজল আর কষ্টজলের মিশেলে নতুন এক জলে ভরিয়ে ফেলব স্বপ্নালু চোখ, খর-ছাওয়া মন?
না হলে ওই বৃদ্ধের মতো আমরাও মুখ ফসকে বলে ফেলব- অভিশাপ!
কার অভিশাপ?
সেই অভিশাপের পরের শিকার কে?
আমার, আপনার, না অন্য কারও সন্তান?
কার গগনবিদারী চিৎকারে আমরা বরাবরের মতো বন্ধ করে ফেলব আমাদের লজ্জাহীন চোখ, বধির করে ফেলা কান, ময়লার আস্তরণে চাপাপড়া হৃদয়?