নাসির ভুঁইয়া

নিজের নামটা শুধু বলতে পারতেন তিনি – নাসির ভূঁইয়া। আর বলতে পারতেন বাড়ির সামনে একটা বড় খেলার মাঠ আছে, পুকুর আছে আর মসজিদ আছে।

দশ বছর ধরে নিখোঁজ মানসিক ভারসাম্যহীন লোকটি বাংলা বলেন ঠিক আছে, কিন্তু বাড়ি কোথায়? ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নাকি বাংলাদেশে?

এহেন মানুষের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করে তার পিতার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন ঢাকা, দুবাই ও কলকাতার একদল শখের হ্যাম রেডিও অপারেটর।

কীভাবে সম্ভব হলো এটা?

নাসির ভূঁইয়া সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বছর দশেক আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান।

তারপর কোনোভাবে বছর চার-পাঁচেক আগে হিন্দুদের তীর্থস্থান গঙ্গাসাগরে পৌঁছিয়ে যান।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী তাকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

এবছর গঙ্গাসাগর মেলার পরে হ্যাম রেডিও অপারেটররা যখন সেখানকার কাজ গোটাতে শুরু করেন, তখনই এই ব্যক্তির ব্যাপারে তারা জানতে পারেন।

তারপর শুরু হয় খোঁজ।

ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিও ক্লাবের সম্পাদক ও হ্যাম রেডিও অপারেটর অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস বলছিলেন, “প্রথমে শুনে মনে হয়েছিল অসাধ্য কাজ”।

“কিন্তু যখন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি আমরা। হঠাৎই একদিন তিনি বলেন যে তাঁর বাড়ি বাংলাদেশে ছিল আর তার কয়েকজন বন্ধু সেদেশ থেকে দুবাইতে কাজ করতে গেছে। কয়েকজনের নামও বলেন তিনি। এই সূত্র ধরেই আমাদের খোঁজ শুরু হয়।”

বিবিসি বাংলায় আরো পড়ুন:

ভাইরাসের আস্তানায় পরিণত জাহাজ থেকে নামছেন যাত্রীরা

কেউ কি করোনাভাইরাসের টিকা বের করবে?

কম দক্ষদের ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি করতে যাচ্ছে ব্রিটেন

যে কারণে আর কোন যৌনকর্মীর জানাজা পড়াবেন না গোলাম মোস্তফা

হ্যাম রেডিওর মাধ্যমেই তারা প্রথমে কেরালায় যোগাযোগ করেন, আর সেখান থেকে যোগাযোগ হয় দুবাইতে বাংলাদেশের কয়েকজন হ্যাম অপারেটরের সঙ্গে, ছবিও পাঠানো হয়।

তারা নিজেদের দেশের মানুষদের মধ্যে খুঁজতে শুরু করে নাসির ভূঁইয়ার কোনও পরিচিত আছে কি না।

আবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেসব শখের হ্যাম রেডিও অপারেটর দুবাইতে কাজে গেছেন, তাদেরও জানানো হয়।

“একজন ছবি দেখে বলেন চেনা চেনা লাগছে। সম্ভবত উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। যদিও আমরা ছবি আর নাম ছাড়া আর কিছুই জানাই নি দুবাইতে। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হই যে সব কিছুই যখন মিলে যাচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই এবার নাসির ভূঁইয়ার ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যাবে”।

“দুবাইয়ের সেই বাংলাদেশি ব্যক্তির কাছ থেকেই গ্রামের নাম জানা যায়,” বলছিলেন মি. বিশ্বাস।

এরপরের খোঁজটা বিশেষ কঠিন ছিল না। কলকাতা থেকে বেতার বার্তা যায় বাংলাদেশের হ্যাম অপারেটরদের কাছে।

সার্ক দেশগুলির হ্যাম অপারেটরদের মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক আছে, যেখানে কোনও জরুরি মেসেজ দেওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময় আছে – ভারতের সময় রাত নটা থেকে দশটা পর্যন্ত।

পিতা-পুত্রের দেখা:

ওই নেটওয়ার্কে জরুরি বার্তা দেওয়ার পরের দিনই ঢাকা থেকে হ্যাম অপারেটরদের একটি দল পৌঁছায় নবাবগঞ্জে।

সেখানে খোঁজ করতেই পাওয়া যায় নাসির ভূঁইয়ার পরিবারকে।

জানা যায় যে, তার তিন ভাইও বিদেশেই থাকেন। একজন সম্প্রতি বাহরাইন থেকে দেশে ফিরেছেন, আরেক ভাই কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশে ফিরে যাবেন।

মি. বিশ্বাস বিবিসিকে বলেন, “ওর ছোট ভাই বলেন দাদাকে দেশে এনে রাখব কার কাছে। আমাদের বাবা আছেন, কিন্তু তিনি থাকেন দিদির কাছে। আর মি. ভূঁইয়ার শ্বশুরবাড়িতে থাকেন তার স্ত্রী-পুত্র”।

পরে অবশ্য মি. ভূঁইয়ার ভাইদের পক্ষ থেকে আর তেমন উৎসাহ দেখা যায়নি, তবে তার শ্বশুর খুবই আগ্রহী, বলছিলেন মি. বিশ্বাস।

এরপরে দিদির বাড়ি থেকে ভিডিও কল করে বাবার সঙ্গে নাসির ভূঁইয়ার কথা বলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মি. নাগ বিশ্বাসের কথায়, “সে যে কী ইমোশনাল দৃশ্য, যে না দেখেছে সে বুঝতে পারবে না। ওর বাবা কানে শোনেন না। হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে মোবাইলে দেখে কেঁদেই চলছিলেন বাবা আর ছেলে।”

এখন নাসির ভূঁইয়াকে দেশে ফেরানোর পালা।

পশ্চিমবঙ্গের হ্যাম রেডিও অপারেটররা চিঠি দিয়েছেন ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কলকাতার দপ্তরে।

আর নাসির ভূঁইয়াকে দেখাশোনা আর সরকারি স্তরে যোগাযোগ সবই করছে জেলা প্রশাসন।

হ্যাম রেডিওর মাধ্যমে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে বিশ্বের নানা প্রান্তেই শুধু নয়, মহাকাশেও যোগাযোগ করা যায়। দুর্যোগ বা বিপর্যয়কালীন সময়ে ইন্টারনেটের পাশাপাশি এই বেতার তরঙ্গও যোগাযোগের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

এটা আসলে এক ধরণের শক্তিশালী বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে বেসামরিক জনগোষ্ঠীও ব্যবহার করতে পারেন।

তবে এজন্য লাইসেন্স নিতে হয়, এবং লাইসেন্স পাওয়ার জন্যএকটি পরীক্ষাতেও বসতে হয়।

বহু বছর ধরেই বিশ্বের নানা স্থানে গড়ে উঠেছে এই বেতার ব্যবহারকারীদের ক্লাব যেগুলো হ্যাম রেডিও ক্লাব বলে অনেক জায়গায় পরিচিত।

তবে এই শখটি ঠিক বহুল চর্চ্চিত নয়। নিয়মকানুনেরও কড়াকড়ি আছে রাষ্ট্রভেদে।

অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস বলছিলেন, হ্যাম রেডিও শখের পাশাপাশি একধরনের নেশাও বটে।

আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের (আইটিইউ) নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকটি দেশের হ্যাম অপারেটরদের লাইসেন্স দেওয়া হয় একটা পরীক্ষায় পাশ করার পরে।

আইটিইউ-ই ঠিক করে দিয়েছে কোন দেশের কল সাইন কী হবে।

কল সাইনটাই হচ্ছে ব্যবহারকারীদের পরিচিতি।

ভারতের হ্যাম অপারেটরদের কল সাইন শুরু হয় ভিইউ দিয়ে বাংলাদেশের কল সাইন হচ্ছে এস-২১।

মি. বিশ্বাস বলছিলেন,”আমি যখন রেডিওর সামনে বসি, প্রথমেই বার্তা দিই ‘সিকিউ, সিকিউ, সিকিউ, দিস ইজ ভিক্টর, ইউনিফর্ম নাম্বার টু জুলিয়েট ফক্সট্রট আলফা.. এনি ওয়ান ইন ফ্রিকোয়েন্সি’? ওটাই আমার নির্দিষ্ট কল সাইন। আমার বার্তা শুনে হয়তো কেউ জবাব দিল ‘রজার রজার, দিস ইস শিয়েরা টুয়েন্টি ওয়ান হোটেল ডেল্টা’। আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম পাশের দেশ বাংলাদেশ থেকে কেউ জবাব দিচ্ছেন। আমরা তো কেউ কাউকে চোখে দেখিনি, এই কল সাইন শুনেই একজনকে চিনতে পারি আমরা”

বিশ্বে এবং বহির্বিশ্বে বার্তা আদানপ্রদানের জন্য একই ভাষা ব্যবহার করেন হ্যাম অপারেটররা। যেমন সন্তানকে ডাকা হয় ‘হার্মোনিক’ বা স্ত্রীকে বলা হয় ‘এক্সওয়াইএল’, কম বয়সী মেয়েদের বলা হয় ‘ওয়াইএল’ বা ইয়াঙ্কি-লিমা বলে। মুখোমুখি দেখা করার বার্তা পাঠাতে বলা হয় ‘আইবল’।

হ্যাম রেডিও অপারেটররা শখের থেকেই শুরু করেন, কিন্তু তারপরে সামাজিক কাজেও জড়িয়ে পড়েন – যেমন হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বার করার মতো কাজ।

আর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে যখন টেলিফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট সব ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়ে, তখন প্রশাসনও ভরসা করে হ্যাম রেডিও অপারেটরদের ওপরেই।