নকল ও অবৈধ পণ্যে বাজার সয়লাব। ফলে সাধারণ ক্রেতারা প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। নিরাপদ পণ্য ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারা ভোক্তার অধিকার। ভোক্তার অধিকার সমুন্নত রাখতে দেশে একাধিক আইনও রয়েছে। কিন্তু আইন কি নকল পণ্য ঠেকাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে? সমকালের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, প্রচলিত আইনের শক্ত প্রয়োগ না থাকায় নকল পণ্য উৎপাদন ও বিপণনকারীদের ঠেকানো যাচ্ছে না। যদিও নকল পণ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেশে আইনের অভাব নেই। তবে বড় বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির নেই। আইন প্রয়োগে শিথিলতা, ভোক্তার নিজের সচেতনতার অভাব ও দুর্নীতির একটি দুষ্টচক্রের কারণে গুরুতর অপরাধ করেও নকল পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, গত বছর নকল ও ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলাও করেননি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এই আইনের ২৫ এর (গ) ধারায় মামলা করলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ছোটখাটো সাজা ও জরিমানা হয়। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে এরাই আবার অপরাধে জড়ায়। তবে গত ১২ মাসে নকল ও ভেজাল পণ্যের কারবারিদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৯টি মামলা করেছে র‌্যাব। সংস্থাটির দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, নকল পণ্য তৈরি ও বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হলেও চূড়ান্তভাবে এসব মামলার ফল ভালো পাওয়া যায় না। অনেকেই সাক্ষ্য দিতে হাজির হয় না। তাই আসামিরা পার পেয়ে যায়। নকল ও ভেজাল পণ্যের কারণে দায়ের করা মামলায় দেশের কারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই।

নকল ও অবৈধভাবে বাজারে ছাড়া হচ্ছে এমন পণ্যের মধ্যে প্রসাধনী, ওষুধ, সিগারেট, মোবাইল ফোনের হ্যান্ডসেট ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস, রেভিনিউ স্ট্যাম্প উল্লেখযোগ্য। বাজারে বিক্রি হওয়া প্রসাধনীর একটি বড় অংশই নকল। এগুলো ক্ষতিকর রাসায়নিক ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে তৈরি এসব প্রসাধনী ব্যবহার করে অনেকে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। নকল ওষুধের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্রেতাদের পক্ষে নকল ওষুধ চেনা সম্ভব নয়। তবে সরকারকে কর না দিয়ে ট্যাক্স স্ট্যাম্প নকল করে কিংবা পুরোনো স্ট্যাম্প ব্যবহার করে এবং চোরাপথে বিদেশ থেকে এনে অবৈধভাবে বাজারজাত করা হচ্ছে সিগারেট। মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজারেও নকলের দৌরাত্ম্য রয়েছে। অপরাধীরা সরকারের রেভিনিউ স্ট্যাম্পও জাল করছে। এখানেও সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি নকল হচ্ছে প্রসাধনসামগ্রী। দেশে ব্যবহূত প্রসাধনসামগ্রীর প্রায় ৪০ শতাংশ নকল। আর দেশে ব্যবহূত মোবাইল ফোন সেটের ২০ শতাংশ নকল। নকল ইলেকট্রিক পণ্যের আয়ু স্বল্প হওয়ায় দেশে ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের ওপর। নকল মোবাইলের রেডিয়েশন উচ্চ মাত্রার।

সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নকল পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত ঠেকানো না গেলে তা একদিকে দেশের অর্থনীতিকে যেমন আরও ক্ষতির মুখে ফেলবে, তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়বে। তাই নকল পণ্য উৎপাদন ঠেকানোয় সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এটি করা না গেলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা আরও ক্ষতির মুখে পড়বেন। সরকারের রাজস্ব আহরণে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, নকল ও ভেজাল পণ্য কিনে প্রতারিত হলে তার প্রতিকারের জন্য ভোক্তা নিজেই আইনি সুরক্ষা পেতে পারেন। বিশ্বের অনেক দেশেই নকল পণ্যের বিরুদ্ধে ভোক্তার ব্যক্তিগত সচেতনতা অনেকদূর এগিয়েছে। নানা কারণেই ভোক্তা আইন প্রয়োগে দেশে ভোক্তার সচেতনতা সেই পর্যায়ে পৌঁছেনি। ১৯৯৪ সালে ইসা লিসবেক নামের এক মার্কিন নারীর শরীরে ম্যাকডোনাল্ডসের ৫০ সেন্টের কফি পড়ে পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাকে দিতে হয়েছে ছয় লাখ ডলার। অভিযোগ ছিল- স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কফি সরবরাহ করা হয়েছিল।

ক্রেতা অধিকার ও নিরাপদ পণ্য নিশ্চিত করতে গত বছর হাইকোর্ট থেকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়। হাইকোর্ট পণ্যের মান ঠিক রাখতে বছরজুড়ে বিএসটিআইকে নিয়মিত ল্যাব পরীক্ষারও নির্দেশ দিয়েছে। ভেজাল খাদ্যপণ্য ও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি রুখতে ভোক্তারা যাতে যে কোনো সময়ে অভিযোগ জানাতে পারেন, সে জন্য হটলাইন সার্ভিস চালু করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। আদালত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে উপজেলা পর্যায়েও ভেজাল ও মানহীন পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার পরামর্শ দেন।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি যারা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনের শক্ত প্রয়োগ করতে হবে। এটা না হলে শক্ত আইন না থাকলেও বাস্তবে তার সুফল পাওয়া যাবে না। বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলার বিচার দ্রুত করতে হবে। অল্প সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে সাক্ষী হাজির করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করলে নকল পণ্যের সঙ্গে জড়িত অন্যরা সতর্ক হবেন। এ ছাড়া মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবীদের সততার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, নানা কৌশলে নকল পণ্য তৈরি ও বিক্রি করা হচ্ছে। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। নিরাপদ খাদ্য আইন সংশোধন করে খাবারে নকল ও ভেজাল মেশানোর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা জরুরি।

র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সমকালকে বলেন, জামিনে বেরিয়ে বারবার একইভাবে নকল পণ্য তৈরি করছে একই চক্র। এ কারণে তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না। দেশে আইন অনেক থাকলেও বড় নকল পণ্যের সঙ্গে জড়িতদের বড় কোনো শাস্তি হয়নি।

ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী একাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সমকালকে জানান, নকল পণ্য উৎপাদনকারী ও বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে তারা সাধারণত চারটি আইন প্রয়োগ করে থাকেন। তা হলো- নিরাপদ খাদ্য আইন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, বিএসটিআই আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইন। এই আইনের অধীনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিধান রয়েছে। তবে মোবাইল কোর্ট কাউকে দুই বছরের বেশি সাজা দিতে পারেন না।

সংশ্নিষ্টরা জানান, নকল ও ভেজাল রোধ এবং নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে বাংলাদেশে আইন রয়েছে অনেক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনগুলোর অধীনে কিছু জরিমানা ও সর্বোচ্চ দুই বছরের শাস্তি দেওয়া হয়। কেউ কেউ ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেন। অনেকে আবার জামিনে বেরিয়ে একই ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছেন। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (গ) এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল মেশালে বা ভেজাল খাদ্য ও ওষুধ বিক্রি করলে বা বিক্রির জন্য প্রদর্শন করার অপরাধ প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদে র বিধান আছে। তবে এই আইনে মামলা হয় খুবই কম। আবার মামলা হলেও কারও শাস্তির নজির নেই।

বর্তমানে দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নকল ও ভেজাল রোধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। বিএসটিআই আইন-১৯৮৫ সংশোধন করে ২০১৮ সালে নতুন আইন করা হয়। আগের আইনে জরিমানা ছিল সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা। নতুন আইনেও জরিমানার অঙ্ক এক লাখ টাকা। আর সাজার মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই বছর।

র‌্যাবের একাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, ওষুধ ছাড়াও যদি বড় কোনো নকল ও ভেজাল চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়, তখন বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেওয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের কারণেই অনেকে নকল ও ভেজাল পণ্য উৎপাদন করতে কিছুটা হলেও ভয় পায়। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় প্রায় সারাবছর নকল পণ্যের বিরুদ্ধে কমবেশি একধরনের নজরদারি থাকে। তাই দেখা যায়- যারা নকল ও ভেজাল পণ্য তৈরি করছে, তারা ঢাকার আশপাশের এলাকায় গিয়ে আস্তানা তৈরি করে। তাই পণ্যের নকলমুক্ত বাজার নিশ্চিত করতে হলে নজরদারি বাড়াতে হবে সারাদেশে।

নকল পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযানে জড়িত এক কর্মকর্তা জানান, নকল ও ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়েও তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকায় বিভিন্ন সময় সমস্যায় পড়েন তারা। অনেক খাবারের সঙ্গে ‘রঙ’ মেশানো হয়। তবে কী ধরনের রঙ কতটুকু মেশালে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর তা যথাযথভাবে পরীক্ষার জন্য মেশিনপত্র দেশে নেই বললেই চলে।

নকল পণ্য কিনে প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিকার আইনে জড়িতদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনি সুযোগ রয়েছে। সেখানে বলা আছে- ১২টি বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে নালিশ করতে পারবেন ভোক্তা। এর মধ্যে রয়েছে নকল পণ্য বা ওষুধ প্রস্তুত বা উৎপাদন, নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর দ্রব্য মিশ্রিত কোনো খাদ্যপণ্য বিক্রি বা বিক্রির প্রস্তাব, ওজনে কারচুপি ইত্যাদি।

কোনো ভোক্তা প্রতারিত হলে পণ্য কেনার ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিকার চেয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করতে পারেন। এরপর তদন্ত শুরু করবে ভোক্তা অধিদপ্তর। ভোক্তার অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে পরিমাণ আর্থিক জরিমানা করা হবে, তার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়ার বিধান রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে নকল পণ্য উৎপাদন বা বিক্রি করলে এক থেকে তিন বছর কারাদ এবং ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান করা হয়েছে। তবে দেশে সচেতনতা সেভাবে তৈরি না হওয়ায় এই আইনে ভোক্তাদের আইনি প্রতিকার নেওয়ার উদাহরণ খুব বেশি নেই।

নকল পণ্য প্রতিরোধে বিএসটিআই আইন প্রয়োগ করে থাকেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। এই আইনে বলা আছে- লাইসেন্স ছাড়া স্ট্যান্ডার্ড মার্ক ব্যবহার করলে দুই বছরের জেল এবং সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দে র বিধান করা হয়েছে। তবে জরিমানার পরিমাণ কোনোভাবেই ২৫ হাজার টাকার নিচে হবে না। আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে উল্লিখিত শাস্তি দ্বিগুণ হবে।

১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন করা হয়। আইনের ২৫ ধারায় কালোবাজারে লেনদেনের দ, ২৫ (এ) ধারায় মুদ্রা- নোট এবং সরকারি স্ট্যাম্প জাল করার দ, ২৫ (বি) ধারায় চোরাচালানের দ ; ২৫ (সি) ধারায় খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, প্রসাধন দ্রব্যে ভেজাল মিশিয়ে নকল করা বা বিক্রির দ, ২৫ (ডি) ধারায় অপরাধ সংঘটনে উদ্যত হলে দ এবং ২৫ (ই) ধারায় কোম্পানির অপরাধের বিষয়ে বলা আছে। (শেষ)