সমতা- এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য। মানুষ হিসেবে নারী যে ভিনগ্রহের কেউ নন, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে নারী হিসেবেই দেখা হয়। মানুষ, তবে কিছুটা ‘উন’ পর্যায়ে রাখা হয়। একজন পুরুষ যে কাজটি খুব সহজেই পারবেন, নারী তা পারবেন না বলে ধারণা করা হয়। সমাজে পুরুষ শতভাগ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও নারী তা পারেন না। সমাজের গঠনতন্ত্র আমাদের তাই বলে। পুরুষতান্ত্রিক মনমানসিকতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলে এসেছে নারী-পুরুষ বৈষম্য। এই বৈষম্য থেকে সমতার পথে যাত্রাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত সমাজ গড়ে তুলবে। আজ ৮ মার্চ নারী দিবসে আমরা ‘সমতা’ প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসতে  চাই। এই সমতা পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অংশে।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নারীর উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতার মাত্রার ধরন ভিন্ন রকম। তবে নারীর অর্জন অনেক। নারীকে নারী হিসেবে দেখা হচ্ছে বলে সেই উন্নয়ন আমাদের চোখে পড়ছে না। গত কয়েক দশকে নারীর আর্থসামাজিক উন্নয়নেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। পাশাপাশি বড় সমস্যা হয়ে আছে নারীর প্রতি সহিংসতা। বর্তমান সময়ে এর মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। নির্যাতনের ধরনও বীভৎস হয়ে উঠছে। প্রাচীনকালে নারী যেভাবে নির্যাতনের শিকার হতো, এখনও হচ্ছে। ঠিক একই রকমভাবে। শারীরিক নির্যাতনের কথা, বীভৎসতার কথা আমরা জানতে পারি। কিন্তু মানসিক নির্যাতন? সেটার কথা খুব একটা আসে না। নারী বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীকে দ্বিগুণ পরীক্ষা দিয়ে কর্মক্ষেত্রে আসতে হয়। তাকে প্রমাণ করতে হয় কর্মদক্ষতা। প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে প্রমাণ করতে হয় তা। যেটা একজন পুরুষ কর্মীকে অতটা দেখাতে হয় না। ধরেই নেওয়া হয়, নারী তার সমকক্ষ হতে পারে না। নারীকে করতে হয় দ্বিগুণ কাজ।

২০০৭ সালে অভিষেকের পর থেকে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। পুরুষ দলের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে নারী ক্রিকেটাররাও। সম্প্রতি বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা এশিয়া কাপ জয় করেছে। আমাদের নারী ক্রিকেটের জয়জয়কার। অথচ পুরুষ ক্রিকেটারের বেতন-ভাতা ও মর্যাদার সমান তারা পান না। এটা একটা বড় বৈষম্য। এটা বেসরকারি পর্যায়ে হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয়ভাবেই হচ্ছে।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষে বৈষম্য রয়েছে। এগুলোই প্রমাণ করে বাংলাদেশে নারীর সমতা এখনও নিশ্চিত হয়নি, বৈষম্য রয়েছে। সরকারপ্রধান নারী। ৩০ বছর ধরে সরকারপ্রধান নারী হওয়ার পরও রাজনীতিতে আমরা বৈষম্য দেখতে পাই। আমরা যদি রাজনীতির ক্ষেত্রটি দেখি, তাহলে দেখব এখানেও সমতা পায়নি নারী। বরং শিকার হচ্ছে বৈষম্যের।

রাজনীতি-সমাজে যেমন বৈষম্যের শিকার, তেমনি পরিবারেও নারীর প্রতি বৈষম্য প্রকট। এটা এত অমানবিক পর্যায়ে হয় যে, মাঝে মাঝে আমাদের বিস্মিত হয়ে যেতে হয়। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন জরিপের মধ্যে দেখে এসেছি, নারী ঘরেই নির্যাতনের শিকার হন বেশি। সেটা শারীরিকভাবে যেমন, মানসিক নির্যাতন আরও কয়েকগুণ। যখন আপনি ঘরের মানুষকে নির্যাতন করবেন, বৈষম্যের শিকার করবেন; তখন সে বাইরে কীভাবে বৈষম্যহীন আচরণ পাবে? এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য- প্রজন্ম ধরে সমতা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যখন দেখবে তার মা ঘরে নির্যাতিত, তখন ছেলেরা ভাববে এভাবে নারীকে নির্যাতন করা যাবে। আর মেয়েশিশুরা ভাববে, নির্যাতন সহ্য করাও স্বাভাবিক বিষয়।

কর্মক্ষেত্র, রাস্তাঘাট, রাজনীতি, খেলাধুলা সব জায়গাতেই নারী পিছিয়ে আছেন। বৈষম্য এবং বৈষম্যের মানসিকতা দূর করে নারীর অবস্থান শক্তিশালী করা না গেলে এ সহিংসতা প্রতিরোধ করা যাবে না। এই সহিংসতা প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই দূর হবে বৈষম্য। যখন সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্যহীন থাকবে, সমতার দেখা মিলবে তখনই। মুজিববর্ষে জাতির পিতার প্রতি এটাই হবে শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা