আ: রশীদ হাওলাদার, পটুয়াখালী প্রতনিধি :
পটুয়াখালী জেলা সংবাদদাতা:নদীতে পানির অভাব নেই ,শুধূ মাত্র বিশুদ্ধ খাবার পানির খোজে হাহাকার চলছে পটুয়াখালী পৌর এলাকার সর্বত্র। পানির খোজে এক টিউব ওয়েল থেকে অন্য টিউব ওয়েলে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে ছুটছে পৌর বাসী।জলবায়ূর প্রভাব সহ ভূগর্ভস্থ পানির উপর অতিমাত্রার নির্ভরশীলতার কারনে ভূগর্ভস্থ পানির স্থিতীতল প্রতিবছর ক্রমাগত নীচে নেমে যাওয়ায় হুমকীর মুখে পড়ছে পটুয়াখালী পৌরবাসী।হস্তচালিত গভীর নলকূপ (টিউবওয়েলগুলি)গুলি ক্রমেই অকেজো হয়ে পড়ার কারনে ভবিষেৎ বিশুদ্ধ পানির মারাতœক সংকট দেখা দেয়ার আংশকা দেখা দিয়েছে। এ দিকে মে মাসের প্রথম দিক শূরু করে পানির সংকট বৃদ্ধি পেতে থাকে বিশুদ্ধ খাবার পানির একমাত্র ভরসা হস্ত চালিত নলকূপগুলিতে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ দিশেহারা হয়ে একবাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে কলস নিয়ে সকাল সন্ধ্যা ছুটছে।বিশেষ করে রমজান মাসে বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য মানুষ চরম ভোগান্তির চরম পর্যায় পৌছেছে।
পৌর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ১৮৯২ সালের ১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত পটুয়াখালী পৌরসভাটি বর্তমানে ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় দেড় লাখ লোকের নাগরিক সুবিধার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৮০ সালে পৌর কর্তৃপক্ষ পৌরবাসির জন্য পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করে। এর আগে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর পৌরবাসিকে পানি সরবরাহ করতো। শুরুতে ৫টি উৎপাদক নলকূপের মাধ্যমে সাড়ে ৭ কিলোমিটার পাইপ লাইনে পৌরবাসিকে পানি সরবরাহ করা হয়। ২০০৪ সালে ড্যানিডার প্রকল্পের আওতায় দু’টি ওভারহেড ট্যাংকির মাধ্যমে ৫৮ কিলোমিটার পাইপ লাইনে পানি সরবরাহ শুরু হলে ১৮০০ শ’ গৃহলাইন সংযোগ দেওয়া হয় এবং ২০১১ সালে তা ২৮০০শ’ গৃহলাইন সংযোগে উন্নীত করা হয়। পরবর্তীতে পৌরসভার নিজস্ব খরচে আরও দু’টি উৎপাদক নলকূপ স্থাপন করা হয়। এবং দীর্ঘ দিন পানি সরবরাহের লাইনের সংযোগ বন্ধ থাকার পর ঐ দুটির মাধ্যমে ২০১৪ সাল সরবরাহ নতুন করে চালু করে গৃহ সংযোগ ছিল ৪২০০ শ’ উন্নীত হয়। পরবর্তীতে দেশের ৩৭ জেলায় পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওয়ায় ডিপিএইচই ও পৌরসভার সমন্বয়ে ৭টি উৎপাদক নলকূপ স্থাপনের কাজ শুরু হয়। যার মধ্যে ৩টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং একটি ইতোমধ্যে চালুও হয়েছে বাকি ৪টির কাজ চলমান রয়েছে,্এর মাধ্যমে পৌর এলাকায় নতুন করে ৩৫ কিলোমিটার লাইন চালু করা হয় ,বর্তমানে পটুয়াখালী পৌর এলাকায় ৯৩ কিলোমিটার পানির লাইনের মাধ্যমে ৪৮৮৭ গৃহসংযোগ রয়েছে এর মধ্যে আবাসিক ৪’৮২৫ টিএবং বানিজ্যিক ৬২টি।
পটুয়াখালী জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিককালে পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে আবহাওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে গেছে। হস্তচালিত গভীর নলকূপে পানি উত্তোলন ক্ষমতা ২৬ ফিট স্তর পর্যন্ত। কিন্তু সেখানে এখন পানির স্থিতিতল রয়েছে ৩২ ফিটে। যেখানে ২০১৬ সালে পানির স্থিতিতল ছিল ২৪ ফিটে এবং ২০১৭ সালে পানির স্থিতিতল ছিল ২৬ ফিটে। সেখানে বর্তমানে (২০১৮ সালে) পানির স্থিতিতল দাঁড়িয়েছে ৩২ ফিটে। এ ছাড়া পূর্বে বসানো হস্তচালিত নলকূপগুলি যে লেয়ারে বসানো ছিল প্রডাকসন টিউবওয়েলগুলিও সে লেয়ারে বসানো থাকার কারনে বর্তমানে পৌর এলাকায় জনবসতি বৃদ্ধির সাথে সাথে পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রডাকসন টিউবওয়েলগুলি পানির লাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহের কাজে অধিকাংশ সময় চালু থাকায় টিউবওয়েলগুলিতে পানি উঠছে না।
জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও জানায়, পটুয়াখালী পৌর এলাকায় দেড় ইঞ্চি ব্যসের গভীর নলকূপ রয়েছে ১ হাজার ১৫০টি। এর মধ্যে সরকারি রয়েছে ৮৫০টি এবং ব্যক্তিগত রয়েছে ৩০০টি। পটুয়াখালী পৌর শহরে গভীর নলকূপের জন্য দু’টি লেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম লেয়ারে পানি উত্তোলনের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ৮৮০ ফিট থেকে ৯৪০ ফিটের মধ্যে এবং দ্বিতীয় লেয়ারে রয়েছে ১০১০ থেকে ১১০০ ফিটের মধ্যে। কিন্তু পানির স্থিতিতল অস্বাভাবিক নিচে (৩২ ফিটে) নেমে যাওয়ায় বর্তমানে দ্বিতীয় লেয়ারেও কাজ হচ্ছেনা। এ কারণে শহরের গভীর নলকূপগুলোতে পানি উঠছে না। ওইসব নলকূপে পানি পেতে এখন ১১৪০ থেকে ১১৮০ ফিট পর্যন্ত পাইপ বসাতে হচ্ছে। যারা ১১৪০ থেকে ১১৮০ ফিট পর্যন্ত পাইপ বসিয়েছেন একমাত্র তারাই পানি উত্তোলন করতে পারছেন। এছাড়া পৌর শহরের পানির এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ৭টি উৎপাদক নলকূপ বসানো হচ্ছে। এর মধ্যে ৩টির কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং ৪টির কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিটি উৎপাদক নলকূপ বসাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা করে। এ ছাড়াও আরও দু’টি পানির ওভারহেড ট্যাংকিও করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে টেন্ডারও আহবান করা হয়েছে। কিন্তু দরপত্রে রেট কম হওয়ায় কোন ঠিকাদার এ টেন্ডারে অংশ গ্রহণ করছেন না। ফলে ওভারহেট ট্যাংকি নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এদিকে পৌর কর্তৃপক্ষ পৌর এলাকায় সরকারি ৮৫০টি হস্তচালিত গভীর নলকূপের মধ্যে ৮১০টি সচল এবং ৪০টি অকেজোর কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বাস্তবতা হচ্ছে এই পৌর এলাকায় অকেজো (যেসব টিউবওয়েলে পানি উঠছে না) গভীর নলকূপের সংখ্যা অনেক বেশি। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন মিলিয়ে অন্তত: অর্ধেক টিউবওয়েলেই এখন পানি উঠছেনা। এসব টিউবওয়েল এখন অকেজো পড়ে রয়েছে। এর ফলে রমজান মাসে পটুয়াখালী পৌর শহরে খাবার পানির সমস্যায় ক্রমেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে পোৗরবাসি। এ পৌর শহরে হাতেগোনা কয়েকটি টিউবওয়েলে পানি উঠলেও সেখান থেকে বিশুদ্ধ পানি নেওয়ার জন্য পুরোদমে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কার আগে কে পানি নেবে এ নিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে কাড়াকাড়ি। প্রতি বাসা থেকে ৪/৫টি কলস ভর্তি করে পানি নেয় গৃহকর্তা ও গৃহকত্রী কিংবা গৃহকর্মীরা।
শহরের চরপাড়া এলাকার বাসিন্দা অসিত পাল জানান প্রায় একমাস পর্যন্ত বিভিন্ন লোক দিয়ে কষ্ট করে খাবার পারি আনতে হয়।
শহরের নবাব পাড়া এলাকার বাসিন্দা এ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন জানান,মার্চ এর শুরুতে তার দীর্ঘ্যদিনের টিউবওয়েলটি নষ্টহয়ে যাওয়ায় বিপাকে পরেছেন তারা,রাত জেগে গৃহস্থালীর কাজের জন্য পৌরসভার সরবরাহকতৃ পানি ধরতে হয় ,কিন্তু পৌরসভার সরবরাহকৃত পানি পান করার অনুপযোগী হওয়ায় খাবার পানির জন্য অতিরক্তি টাকা খরচ সহ ভোগান্তী পোহায়ে পানি জোগাড় করতে বাধ্য হচ্ছে তারা।একই এলাকার গৃহবধূ রুপা বেগম জানান,খাবার পানির জন্য প্রতিদিনই ভোগান্তী পোহাতে হচ্ছে নিজেদের পুড়ানো টিউব ওয়েলে পানি উঠছে না,নতুন করে হাউজিং করার কথা বলছেন পানির কাজের মিস্ত্রীরা তাতে প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হবে বলে তারা জানিয়েছেন ।
শহরের জুবিলী স্কুল সড়কের গৃহকর্ত্রী আফসানা বেগম বলেন, ‘এ রমজান মাসে আমারা সময় মতন উজু-গোছল করতে পারছি না। আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। আমরা চাই আমাদের পানির এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হোক’।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল হালিম জানান, পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। বর্তমানে ১ হাজার ১৮০ ফিট পর্যন্ত পাইপের সংযোগ দেওয়া না হলে ভাল পানি পাওয়া যাবে না। তবে, পানির সমস্যা আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে। তারপরও পানির যেটুকু সমস্যা রয়েছে তা ২০ রমজানের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে। এছাড়া নতুন করা ৭টি উৎপাদক নলকূপ চালু হয়ে গেলে পৌর এলাকায় পানির আর কোন অভাবই থাকবে না।
পটুয়াখালী জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার শামসুল ইসলাম জানান, পটুয়াখালী পৌর এলাকায় পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে গেছে। বর্তমানে পৌর শহরে পানির স্থিতিতল রয়েছে ৩২ ফিটে। এছাড়া শহরে বেআইনী ভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন শতশত টিউবওয়েল সহ অতিরিক্ত গভীর নলকূপ স্থাপন এবং এক সঙ্গে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।নদী মাতৃক এই এলাকাকে ভবিষেৎ সুপেয় পানি সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে অতি দ্রুত ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূপৃষ্ঠের উপরের স্বাভাবিক পানি পক্রিয়াকরনে মাধ্যমে ব্যবহারের দিকে নজর বাড়াতে হবে এবং এ লক্ষে সরকার নতুন নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন,ইতোমধ্যে জেলায় জেলা পরিষদের মালিকানাধীন ২৭ টি পুকূর সংস্কার করে সঠিক রক্ষনাবেক্ষনের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহের প্রকল্পের কাজ চলছে।