বসন্তের কোনো এক বিকেল। ঝরা পালকের দিন শেষে সবুজের সমারোহ। সবুজঘেরা সরু পথে রমণীর বয়ে চলা। আকাশভরা বেগুনি শাড়ির ক্যানভাসে শতরঞ্জির কারুকাজ। মায়াময় সুদূরপ্রসারী এক প্রতিবাদী রূপরেখা। বাহারি রঙের খোলাচুলে ঢেউ তুলে দেয় বাসন্তী হাওয়া। কপোলের কালো তিলে আটকে যায় চোখ। বসন্তের ফোটা চিরযৌবন ফুল অকালে ঝরে পড়ে তোমার রূপের মায়ায়। নারীর অহঙ্কার যে শাড়ি তা আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে তোমার শরীরে। এ যেন এক মাধুর্য পূর্ণ সূর্যস্নান।

বাঙালি নারীর সংস্কৃতিতে শাড়ি এক অপার সৌন্দর্যের নাম। নারী তার সৌন্দর্যের-বাঙালিয়ানার প্রকাশ সবই করতে পারে শাড়ির মাধ্যমে। চিরাচরিত বাঙালি জীবনের সঙ্গে শাড়ি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারীর কাছে শাড়ি মানেই ভালো লাগার বিষয়। তবে শাড়ির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হচ্ছে শাড়ির রং। বাঙালির দিবস উদযাপনের বড় একটা অংশজুড়ে রয়েছে রঙের ভাবনা। অনেকে রংকে যোগাযোগের ভাষা হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ বছর নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ‘সবার জন্য সমতা’ বা ‘ইচ ফর ইক্যুয়াল’। আগের বছরের মতো এবারও নারী দিবসের প্রতিপাদ্যে সমতায়নে নারীর সৃজনশীলতায় দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। তবে মানবাধিকারের অনিশ্চয়তা রেখে শুধু প্রতিপাদ্য পূরণ করা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে ওঠে বলে অনেকে মত দেন। বিশ্বব্যাপী উপজীব্য হিসেবে নারীরা এ দিবস উদযাপন করে থাকেন। বিশ্বে একেক দেশে নারী দিবস উদযাপনের লক্ষ্য অভিন্ন হলেও সাংস্কৃতিক প্রভাব ভিন্ন। নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাই মুখ্য হয় অনেক দেশে। আবার কোথাও নারীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেওয়া হয়।

দীর্ঘ কালপরিক্রমায় নারী দিবসের তাৎপর্যের প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বেগুনি রং। আন্তর্জাতিক দিবসগুলোর তাৎপর্যের ওপর এগুলোর পোস্টার বা প্রতীকের রং বেছে নেওয়া হয়। যেমন পয়লা ফাল্কগ্দুনে বাসন্তী, একুশে ফেব্রুয়ারিতে সাদা-কালো, স্বাধীনতা দিবসে লাল-সবুজ, বৈশাখে লাল-সাদা কিংবা রঙিন। বিশ্ব শান্তি দিবস সবুজাভ নীল, বিশ্ব শ্রম দিবস বা মে দিবসে লাল, পরিবেশ দিবসে সবুজ রং ইত্যাদি। প্রতিটি দিবসে আলাদা রঙের প্রতীক হওয়ার পেছনে রয়েছে অনন্য ইতিহাস। আন্তর্জাতিক নারী দিবস মূলত বেগুনির সঙ্গে সাদার মিশেল কিংবা শুধুই বেগুনি।

শাড়ি ছাড়া বাঙালি নারীকে কল্পনা করা যায় না। কিন্তু্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় শাড়ির ব্যবহার এখন কম বললেই চলে, বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের তরুণীদের কাছে। তবে শাড়ি পরার মুহূর্ত এলে দৃশ্যপট বদলে যায়। যেহেতু বাঙালিমাত্রই উৎসবপ্রিয়। তাই নিজেকে সাজাতে একটি বড় মাধ্যম হিসেবে পছন্দের তালিকায় সবার আগে আসে শাড়ি। বিশেষ এ দিবসে বিশেষ রঙের শাড়ি বাঙালি নারীর অনন্য পছন্দ।

প্রতিবাদ ও সমতায়নের প্রতীক

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের নারীরাও সাজেন বেগুনি রং প্রাধান্য দিয়ে। মানুষের জীবনে রঙের বৈচিত্র্য সবসময়। বাঙালির উৎসবপ্রিয়তা বিশ্বময় পরিচিত। আর এসব উৎসব আনন্দে রং হয়ে ওঠে মূর্ত প্রতীক হিসেবে। নারী দিবসের এ রং ভেনাসের, যা কিনা নারীরও প্রতীক। কেননা, বেগুনি নির্দেশ করে সুবিচার ও মর্যাদা; যা দৃঢভাবে নারীর সমতায়নের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম শেষে বেগুনি রং এখন নারীবাদীদের প্রতিবাদের এক অনন্য প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বখ্যাত মার্কিন লেখক অ্যালিস ওয়াকার ‘দ্য কালার পারপল’ বইটিতে যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান নারীদের নিচু অবস্থানের কথা বলতে গিয়ে গোটা নারী সমাজের অধিকারের কথা তুলে ধরেছেন।

সেখান থেকেই নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে গেছে বেগুনি। পোশাকের রংটার মাধ্যমেই জানানো যায় পুরো আবহের সঙ্গে একাত্মতা। আমাদের দেশেও বিশেষ দিবসে বিশেষ রঙের পোশাক পরার চল এভাবেই গড়ে উঠছে অনন্য সব ঘটনার মধ্য দিয়ে।

কেন এই রং?

কেন বেগুনিই হলো নারীর প্রতীকী রং? কিংবা নারী দিবসের রং? কেন এ রংকেই প্রাধান্য দিয়ে পরা হয় পোশাক! এর পেছনেও আছে দীর্ঘ ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নারী শ্রমিকদের হাত ধরেই হয়েছিল এর যাত্রা। নারীর ক্ষমতায়ন এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কিছু সাহসী নারীর পদক্ষেপ ছিল এ ক্ষেত্রে মুখ্য। প্রায় পনেরো হাজার নারী সেদিন নিউইয়র্ক সিটির রাস্তায় নেমে গিয়েছিল। করেছিল নারীর অধিকার রক্ষার আন্দোলন-লড়াই। যার ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর পালন করা হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। তাই ১৯৯৬ সাল থেকে জাতিসংঘ প্রতি বছর নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ঘোষণা করে আসছে। নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সাফল্যগাথা এবং লিঙ্গ সমতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে করা হয় এসব প্রতিপাদ্য। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বৈচিত্র্যের সঙ্গে নানাভাবে দিনটি উদযাপন করে থাকে এবং তাদের সাংস্কৃতিক মতবিনিময় হয় একে অপরের সঙ্গে। তাদের এ দিনে কোনো সুনির্দিষ্ট রঙের পোশাক পছন্দ না থাকলেও আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট আইডব্লিউডি ডটকমের ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়, ‘কেন বেগুনিকেই দিবসের প্রতীক রং ধরা হলো।

আন্তর্জাতিকভাবে নারীর প্রতীক হিসেবে ধরা হয় বেগুনি রংকে। এ রঙের ঐতিহাসিক কারণও রয়েছে। বেগুনি রঙের সংমিশ্রণ যার সবুজ এবং সাদা দেখা হয় নারীর সমমর্যাদার প্রতীক হিসেবে। এর সূত্রপাত ঘটেছিল ১৯০৮ সালে ইউকেতে নারীর সামাজিক ও রাজনৈতিক ইউনিয়ন থেকে। বেগুনিকে দেখা হতো নারীর ন্যায়বিচার ও সম্মানের প্রতীক। সবুজ হলো আশা এবং সাদা বিশুদ্ধতার প্রতিনিধিত্ব করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশুদ্ধতার প্রতীক সাদা কিছুটা বিতর্কিত ও সমালোচনার জন্ম দিচ্ছে। নতুন দিনের ‘নতুন ভোরের সূর্য যেমন আকাশে হলুদ বর্ণ ধারণ করে, ঠিক তেমনি হলুদ রং প্রতিনিধিত্ব করে ‘নতুন ভোরের’। হলুদ রংকে তাই নারীবাদের দ্বিতীয় ধারা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। আর তাই আমরা বলতেই পারি, বেগুনির সঙ্গে সবুজ হলো ঐতিহ্যগতভাবে ‘নারীবাদের’ প্রতীক এবং বেগুনির সঙ্গে হলুদ প্রগতিশীল সমসাময়িক নারীবাদের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে। রঙের প্রতীকী ব্যবহার ছাড়াও দিনটি নারীর জন্য এক অনন্য দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

নারীর জন্য অনন্য দিন

১৯৭৫ সালে প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্র পালন করে নারী দিবস। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ সদস্য দেশকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে দিবসটি উদযাপনের আহ্বান জানানোর পর থেকে ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় দিবসটি। বিশ্বের অনেক দেশে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এর মধ্যে চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার, নেপালে শুধু নারীরাই সরকারি ছুটির দিন উপভোগ করেন।

আমাদের জাতীয় কবি অনেক আগেই বলেছেন, ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সমতার লক্ষ্য অর্জনের সব বাধা, অন্ধকার দূর হোক। আসুক আলো। নদীতীরে সূর্যের রক্তিম আভায় জ্বলজ্বল করে উঠুক নারীর শাড়ির আঁচল।

অসীম আলোয় এগিয়ে যাক সব নারী-এ প্রত্যাশা এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে।