অনলাইন ডেস্ক : কুষ্টিয়ার খোকসার জানিপুর ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা অখিল বিশ্বাস। ওই ইউনিয়নের একতারা হাটের পশ্চিমে তার বাড়ি। গ্রামের মধ্যে অখিলের পরিবারটি মধ্যবিত্ত বলেই পরিচিত। বাড়িতে দুটি আধাপাকা ঘর ছাড়াও মাঠে তার ১০ বিঘা জমি রয়েছে। আরও একটি নতুন ঘরের জন্য পোতা তৈরি করেন তিনি। কিন্তু সেই পোতায় উঠেছে গরিবের জন্য বরাদ্দ থাকা লাখ টাকার ঘর। অখিল ঘর পেলেও তার কয়েকজন গরিব প্রতিবেশী ঘর পাননি! এ নিয়ে তারা চরম ক্ষুব্ধ। অখিলের দেখা না মিললেও তার ভাই সুবীর বিশ্বাসের দাবি- ঘরটি তার নামে বরাদ্দ। আধাপাকা তিন কক্ষের ঘর থাকার পরও তিনি কেন ঘর নিলেন- এমন প্রশ্নে নিশ্চুপ থাকেন।

জানিপুরের অখিলের মতো খোকসা ও কুমারখালী উপজেলার অনেক সচ্ছল পরিবার ‘জমি আছে, ঘর নেই’ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর পেয়েছেন। তারা টাকা দিয়ে নেতাদের ম্যানেজ করে ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন বলে অভিযোগ। স্থানীয় সাংসদের ঘনিষ্ঠজন ছাড়াও ঘর পাওয়ার তালিকায় আছেন বিএনপি-জামায়াতের লোকজন। অথচ যাদের পাওয়ার কথা সেই গৃহহীন, ভিক্ষুক ও প্রতিবন্ধীর নাম তালিকায় কমই আছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে নেওয়া তালিকারও কেউ নেই। আর যেসব ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে, তাতেও নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, দুই উপজেলাতেই পছন্দমতো লোকদের নিয়ে কাজ করায় এমনটি হচ্ছে। আওয়ামী লীগদলীয় স্থানীয় সাংসদ আব্দুর রউফ ঘর তৈরিতে নানা অনিয়মের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও তাদের মনোনীত লোকজনকে দায়ী করেছেন। আর উপজেলার কর্মকর্তারা বলছেন, সাংসদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বন্দ্ব থাকায় কাজ করতে গিয়ে তাদের নানামুখী সমস্যা হচ্ছে।

কুমারখালীর দয়রামপুর গ্রামের প্রতিবন্ধী মুফাজ্জেল হোসেন। লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি কোনোমতে চলাফেরা করেন। তার কয়েক শতক জমি আছে। সেখানে একটি ভাঙা ছাপরা ঘর রয়েছে। তার একমাত্র মেয়েও প্রতিবন্ধী। একটি ঘরের জন্য উপজেলায় ঘুরছেন, কিন্তু বরাদ্দ পাননি। এসি-ল্যান্ড অফিসের বারান্দায় বসে মুফাজ্জেল বলেন, সবার দ্বারেই ঘুরছি একটি ঘরের জন্য, কেউ দিচ্ছে না। একখানে গেলে অন্যজনকে দেখিয়ে দিচ্ছে। তারই মতো নিঃস্ব মাজেদাও ঘরের জন্য ঘুরছেন। মাজেদা বলেন, ঘরের জন্য টাকা চায়। তিন বেলা ভাতই পাই না; টাকা দেব কোথা থেকে! আক্ষেপ করে তিনি বলেন, বড় লোকেরা ঘর পেয়ে যাচ্ছে! টাকা ছাড়া কোনো কাজই হয় না!

উপজেলা প্রশাসন সূত্র আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ‘জমি আছে, ঘর নেই’ এমন লোকজনকে বাছাই করে ঘর নির্মাণ করে দিতে তালিকা প্রণয়নের কথা জানায়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর পেতে হলে একজনকে কমপক্ষে ১০ শতাংশের কম জমি থাকতে হবে। এ প্রকল্পে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে খোকসার ৯ ইউনিয়নে চার কিস্তিতে ৩৫৮টি ঘর নির্মাণের বরাদ্দ দেওয়া হয়। আর কুমারখালীতে দেওয়া হয় ৩১৯টি ঘর নির্মাণের বরাদ্দ। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১ লাখ টাকা। দুই উপজেলায় মোট ৬৭৭টি ঘর নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। খোকসা উপজেলায় ইতিমধ্যে অর্ধেক সংখ্যক ঘর নির্মাণ হলেও কুমারখালীতে তেমন কাজই শুরু হয়নি। এ প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী, পুরো কাজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে হওয়ার কথা। ১৭৫ বর্গফুটের প্রতিটি ঘরের নিচে ইটের পোতা, টিনের বেড়া, টিনের ছাউনি ও প্রি-কাস্ট পিলার ব্যবহারের জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া ঘরে দরজা-জানালাও থাকবে। পুরো কাজ তদারকির জন্য উপজেলা পর্যায়ে একটি কমিটিও রয়েছে। কমিটিতে ইউএনও আহ্বায়ক, সদস্য সচিব পিআইও এবং তিন সদস্য রয়েছেন সংশ্নিষ্ট উপজেলার সহকারী কমিশনার-ভূমি, উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী ও সংশ্নিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।

খোকসার শোমসপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সংলগ্ন পদ্মবিলা গ্রামের মৃত আকমল আলী মণ্ডলের স্ত্রী মজিরন নেছা অনেক চেষ্টা-তদবির করে একটি ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। তিনি জানান, ঘর নির্মাণের জন্য রোজার ঈদের চার দিন পর তার বাড়ির পাশে ১৭টি সিমেন্টের খুঁটি রেখে যায় ঠিকাদার নাসিরের লোকজন। ক’দিন না যেতেই খুঁটি থেকে সিমেন্ট-বালি খসে পড়ে। দুই সপ্তাহ আগে নতুন খুঁটি দিয়ে গেছে। তার ভিটায় এখনও ঘর ওঠেনি। নতুন যে খুঁটি আনা হয়েছে সেগুলোও ভালো না। একই গ্রামের বসিরের স্ত্রী রোজিনাও ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। তিনিও এখন পর্যন্ত ১৭টি ভাঙা খুঁটির দেখা পেয়েছেন। রোজিনার স্বামী বসির বলেন, সব খুঁটি খারাপ। নিম্নমানের খোয়া ও বালু দিয়ে তৈরির কারণে খসে পড়ছে। এগুলো দিয়ে ঘর নির্মাণ করলে ভেঙে পড়বে। একতারপুর গ্রামের বিধবা রূপবান খাতুন উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেনের সুপারিশে ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। জানা যায়, ওই বিএনপি নেতার সুপারিশে আরও কয়েকজন ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। রূপবান খাতুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ওপরে নিম্নমানের কাঠ দিয়ে টিনের ছাউনি দেওয়া হয়েছে। অর্ধেক কাজ বাকি রেখেই ঠিকাদারের লোকেরা চলে গেছে। থাকার জায়গা না থাকায় বৃষ্টিতে রূপবান খাতুনকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

যারা ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন তাদের অনেকেই অভিযোগ করে জানান, একটি ঘর নির্মাণে ৮০০ ইট, দুই বাঁধ টিন, ১৭টি খুঁটি আর কিছু কাঠ লাগছে। যেসব ইট দেওয়া হচ্ছে, তা খুবই নিম্নমানের। ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ইট ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। রড ছাড়াই অনেক খুঁটি ঢালাই দেওয়া হয়েছে। আর ৩৮ মিলি টিনের পরিবর্তে ৩৬ মিলি দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে একেকটি ঘর নির্মাণে ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে না। বাকি টাকা উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও ঠিকাদার মিলে হাতিয়ে নিচ্ছে।

জানা যায়, খোকসার ইউএনও সেলিনা বানু মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। তার স্বামী নাজমু সাদাত সোনালী ব্যাংক শোমসপুর শাখার ব্যবস্থাপক। স্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে তিনি তার বন্ধু বলে পরিচিত নাসির উদ্দিনকে ১২২টি ঘর নির্মাণের দায়িত্ব দিয়েছেন। আরও ১২০টি ঘরের নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের কাজটিও পেয়েছেন তিনি।

জানিপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, তালিকা নেওয়া হলেও সেই তালিকায় একজনও ঘর পাচ্ছে না। সাংসদ তার ঘনিষ্ঠ লোকজনকে দিয়ে নিজের মতো তালিকা করে ঘর দিচ্ছেন। এ জন্য ১০ থেকে ২০ হাজার টাকাও নেওয়া হচ্ছে। নাসির নামে এক আদম ব্যবসায়ী সেই ঘর নির্মাণের কাজ করছেন। উসমানপুর ইউপি চেয়ারম্যান আনিচুর রহমান অভিযোগ করেন, খোকসায় সচ্ছল লোকজনই ঘর পাচ্ছে। জামায়াত-বিএনপির অনেক লোকও ঘর পেয়েছে। নন্দলালপুর ইউপি চেয়ারম্যান নওসের আলী বলেন, এমপির গাড়িচালক পর্যন্ত ঘর পেয়েছে।

কুমারখালী ও খোকসা উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) দায়িত্বে থাকা মাহমুদুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পটি খোকসার ইউএনও সরাসরি তদারকি করছেন। সেখানে কোনো ঘর দেখার সুযোগ হয়নি। সরাসরি ঢাকা থেকে তালিকা এসেছে। যাচাই-বাছাইও করতে পারিনি। সেই তালিকায় কিছু ত্রুটি থাকতেই পারে। আর প্রথমদিকে কাজের মান বিষয়ে অভিযোগ ছিল। এখন কাজ ভালো হচ্ছে।

খোকসায় ইউএনওর দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নূর-এ-আলম বলেন, ঘর নির্মাণ নিয়ে প্রথমদিকে কিছু অভিযোগ উঠেছিল। সেগুলো সমাধান করা হয়েছে। কুমারখালীর ইউএনও শাহিনুজ্জামান বলেন, নীতিমালা মেনেই ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাংসদ আব্দুর রউফ বলেন, ইউএনও ও তার লোকজন নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ঘর নির্মাণ করে বাকি টাকা পকেটে পুরছেন।