'শিশুদের পরিত্যাগ করা নিষিদ্ধ'', ভেনেজুয়েলার সড়কের পাশের দেয়াল জুড়ে এই বার্তা লিখে রেখেছেন শিল্পী এরিক মেহিকানো।

”শিশুদের পরিত্যাগ করা নিষিদ্ধ”, ভেনেজুয়েলার সড়কের পাশের দেয়াল জুড়ে এই বার্তা লিখে রেখেছেন শিল্পী এরিক মেহিকানো। রাজধানী কারাকাসে তার অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের কাছাকাছি একটি ময়লার স্তূপে সদ্যজাত একটি শিশু পাওয়ার পর তিনি এই উদ্যোগ নেন।

মেহিকানো বলছেন, তিনি মানুষজনকে সতর্ক করতে চান যে, ভেনেজুয়েলায় এমন কিছু বিষয় অব্যাহতভাবে ঘটছে, যা আগে কখনোই স্বাভাবিক বলে মনে করা হয়নি।

দেশটির অর্থনীতির অব্যাহত পতন ঘটছে। প্রতি তিনজন ভেনেজুয়েলানের মধ্যে অন্তত একজন নূন্যতম পুষ্টিমানের খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জাতিসংঘ খাদ্য কর্মসূচীর একটি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে।

অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেকে জন্মনিরোধ কিনতে পারেন না, ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের বিষয়টিও অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গর্ভপাত বিরোধী আইনের কড়াকড়ির কারণে নারীদের সামনে বিকল্পও খুব কম।

অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই একটি দাতব্য সংস্থা ২০১৮ সালে জানিয়েছে যে, সড়কে শিশুদের পরিত্যাগ করা বা আবাসিক ভবনের প্রবেশ দ্বারে শিশুদের রেখে যাওয়ার মতো ঘটনা অন্তত ৭০% বেড়ে গেছে।

ভেনেজুয়েলার সরকার এ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের কোন সরকারি তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করেনি। দেশটির তথ্য মন্ত্রণালয় অথবা শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সরকারি সংস্থাও এসব ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেনি।

কিন্তু যেসব সমাজকর্মী এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে, তারা নিশ্চিত করেছেন যে, পরিত্যাগ করা শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে অনানুষ্ঠানিকভাবে দত্তক নেয়ার সংখ্যাও।

কারাকাসের অন্যতম দরিদ্র এলাকাগুলোর একটিতে শিশুদের রক্ষা কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে কাজ করেন নেলসন ভিলাসমিল। তিনি বলছিলেন, বিশৃঙ্খল আর সামান্য তহবিলের দত্তক ব্যবস্থার কারণে বেপরোয়া পিতা-মাতারা ‘শর্টকাট’ পথ বেছে নেন।

যেমন শিশু টমাসের (আসল নাম নয়) গল্পটি এরকম একটি ঘটনা। তার জন্ম হয়েছিল কারাকাসের একটি দরিদ্র মাতার ঘরে, যিনি মনে করেছিলেন যে, শিশুটিকে বড় করে তোলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

যে স্ত্রীরোগ বিশারদের সামনে টমাসের জন্ম হয়, তিনি সহায়তা করতে রাজি হন।

তিনি বলছেন, এটাই প্রথম ঘটনা নয় যে, কোন মা তার শিশুকে বড় করতে অপারগ বোধ করেন। ”তবে প্রথম যখন শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পান করান, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা মন বদলে ফেলেন। কিন্তু সবসময়ে সেটা ঘটে না আর সেজন্যই একটি সমাধান খুঁজে বের করা দরকার।”

তিনি তার একজন রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চল্লিশ বছর বয়সী তানিয়া (আসল নাম নয়) নামের সেই নারী একটি সন্তান নেয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন, কিন্তু গর্ভধারণ করতে পারছিলেন না।

প্রথমে তিনি টমাসকে দত্তক নেয়ার কথা ভাবেন। পরে সিদ্ধান্ত বদলে তার বন্ধু এক দম্পতির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন, যারা টমাসকে নিজের সন্তান হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি হন।

কোন সন্দেহ তৈরি যাতে না হয়, সেজন্য তাদের দ্রুত শিশুটির জন্ম নিবন্ধন করতে হতো। ফলে তানিয়া কর্মকর্তাদের আড়াইশো ডলার ঘুষ দেন, যাতে তারা আসল মায়ের নামের বদলে সেই বন্ধুর নাম টমাসের মা হিসাবে তালিকাভুক্ত করে।

এখন ভেনেজুয়েলার একটি গ্রামে সেই বন্ধু পরিবারে বড় হয়ে উঠছে টমাস। কয়েকদিন আগে টমাসের হাটতে শেখা উদযাপন করেছে পরিবারটি।

তানিয়া বলছিলেন, টমাসের ভালোর জন্য তিনি প্রচলিত দত্তক নেয়ার পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়েছেন, সেজন্য কখনোই অনুশোচনা বোধ করেন না।

”আমি কখনোই এরকম কিছু করার কথা চিন্তা করিনি। কিন্তু ভেনেজুয়েলায় বৈধ দত্তক নেয়ার পদ্ধতি কাজ করে না এবং শিশুটিকে একটি সরকারি এতিমখানায় অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে বড় হতে হতো,” তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন।

মায়ের সম্মতিতেই টমাসকে নতুন পরিবারে দিয়ে দেয়া হয়, কিন্তু ভেনেজুয়েলায় এমন নারীদের শোষণ করার মতো লোকের কমতি নেই।

যেমন ইসাবেল (আসল নাম নয়) যখন দ্বিতীয়বার গর্ভধারণ করেন, তখন তার স্বামী মারা যান। ফলে দ্বিতীয় সন্তানটিকে ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে তিনি ভাবতে শুরু করেন। ”আমি একা ছিলাম এবং ভয় পাচ্ছিলাম যে, আমি হয়তো আমার সন্তানকে ঠিকমতো খাওয়াতে পারবো না।”

পরিচিত একজনের পরামর্শে এক দম্পতির সঙ্গে দেখা করতে তিনি ত্রিনিদাদের একটি দ্বীপে চলে যান। ওই দম্পতি তার সন্তানকে দত্তক নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহী বলে জানিয়েছিল।

তাকে বলা হয়েছিল যে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনিই নেবেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর থেকেই দত্তকের দিয়ে দেয়ার জন্য তার ওপর চাপ দেয়া শুরু হয়। কলম্বিয়ান একজন নারী চাপ দিতে শুরু করেন।

”আমাকে বলা হয়েছিল যে, সব কিছুই আইন মাফিক হবে এবং কখনোই সন্তানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে না। কিন্তু ত্রিনিদাদে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম যে, আমি আসলে একটা মানব পাচারকারী চক্রের জালে আটকে পড়েছি।”

”আমাকে সবসময়েই নজরদারি করা হতো।”

ইসাবেল বলছেন, তিনি যে বাসায় ছিলেন, সেখান থেকে তাকে বের হতে দেয়া হতো না। ভেনেজুয়েলায় ফেরত যাবার যে রিটার্ন টিকেট দেয়ার কথা ছিল, সেটাও তাকে কখনোই আর দেয়া হয়নি।

কয়েক সপ্তাহ পরে ত্রিনিদাদের একটি হাসপাতালে অপরিণত শিশুর জন্ম দেন ইসাবেল। তিনি শিশুটিকে রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু জন্মের পরপরই কলম্বিয়ান একজন নারী এবং একজন পুরুষ তার ওপর চাপ দিতে শুরু করে। ওই ব্যক্তি নিজেকে একজন আইনজীবী বলে দাবি করেছিলেন।

”তারা আমাকে বলে যে, নতুন পিতামাতা পার্কিং লটে অপেক্ষা করছে এবং আমাকে কিছু ইংরেজি কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে, যা আমি বুঝতে পারছিলাম না। সেই সঙ্গে শিশুটিকে তাদের কাছে তুলে দিতে হবে।”

প্রথমে তাতে রাজি হননি ইসাবেল। কিন্তু পরের সপ্তাহে তাকে আটকে রাখা ব্যক্তিরা চাপ বাড়িয়ে যায়। তার খাবার, ওষুধ এবং ন্যাপি সরিয়ে নিয়ে যায়।

”অবশেষে আমি আমার সন্তানের জীবন বাঁচানোর জন্য আর ভেনেজুয়েলায় ফেরত আসার জন্য ছেলেটিকে তাদের কাছে তুলে দিতে বাধ্য হই,” কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন।

বেসরকারি একটা সংস্থার সহযোগিতায় এখন সন্তানকে ফেরত আনার আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইসাবেল। শিশুটি এখন ত্রিনিদাদ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। বর্তমানে তিনি সপ্তাহে একদিন সন্তানকে দেখতে পান।

ইসাবেল বলছেন, সন্তানকে ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত তিনি হাল ছাড়বেন না।