দর্পণ ডেস্ক : শীর্ণকায় শরীর। চামড়ার ভিতর মাংসের লেশমাত্র নেই। ঠিকরে বেরিয়ে আসছে পাঁজরের হাড়। কঙ্কালসার হাত-পা গুলো মুচড়ে বেঁকে গেছে। দু’চোখের দৃষ্টিতে সীমাহীন শূন্যতা। বছর সাতেকের আমাল হুসেনের ছবি ফেসবুকে পোস্ট হওয়া মাত্রই তর্ক-বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। ইয়েমেন অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর ছবি দেখে শিউড়ে উঠেছিল গোটা বিশ্ব।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের নগ্ন রূপটা বাইরে এনে প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছিল সেই শিশু। আমালের পরে দশ বছরের গাজি সালহের কঙ্কালসার চেহারাটা যুদ্ধ-যন্ত্রণার আরও এক মর্মান্তিক চেহারা সামনে এনেছিল। আমাল, গাজি নেই, তবে তাদের অনেক প্রতিচ্ছবি ছড়িয়ে রয়েছে ইয়েমেনের আনাচেকানাচে।
যুদ্ধবিমানের চক্কর কাটার শব্দ শুনে ঘুমোতে যাওয়া। রাস্তায় বেরোলে গুলির শব্দ। ঘুম ভেঙে উঠে ধ্বংসের ছবি দেখা। আমাল, গাজির মতো শিশুদের কাছে এটাই বাস্তব ছবি। গত চার বছরে যুদ্ধ, রক্তপাত, বোমার শব্দ রোজনামচা। ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসেব বলছে, এই চার বছরে অনাহারে ধুঁকতে ধুঁকতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৮৫ হাজার শিশুর। রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান বলছে, অপুষ্টিতে বিপন্ন ১ কোটি ৪০ লক্ষ শৈশব। মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে কলেরা। প্রতিদিন নতুন নতুন মৃত্যুর আর্তনাদে ভারী হচ্ছে বাতাস।
গত বছর ইয়েমেনের আসলাম শহরের একটি শরণার্থীশিবিরে অপুষ্ট শিশুদের ছবি তুলেছিলেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের ফোটোগ্রাফার টায়লার হিকস। সেই ছবিগুলি সামনে আনার পরে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায় টায়লারের বিরুদ্ধে। মৃত্যুর যন্ত্রণাকে এত পরিষ্কার ভাবে ফুটিয়ে তোলার সাহস দেখানোর জন্য টায়লারের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। সেই ফোটোগ্রাফার বলেছিলেন, ইয়েমেনের যে কোনও শরণার্থী শিবির যেন শ্মশানপুরী। মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছে প্রতিটি শিশু। রুগ্ন, বেঁকেচুরে যাওয়া সন্তানদের বুকে আঁকড়ে কান্না ভুলেছেন মায়েরা। চোখের সামনে অজস্র মৃত্যু দেখে ভেঙে পড়েছিলেন সেই চিত্রগ্রাহকও। তাঁর তোলা সেইসব ছবিকে উলঙ্গ, অশালীন, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতম হয়ে উঠেছে। দুর্ভিক্ষ গ্রাস করেছে সিংহভাগ এলাকা। খাদ্য সংকট তীব্র। আশি লক্ষ মানুষ আপৎকালীন খাদ্য সাহায্যের ভরসায় বেঁচে আছেন। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সংখ্যা অচিরেই এক কোটি আশি লক্ষ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার অর্ধেকে পৌঁছতে পারে। অনাহার, অপুষ্টিতে ভুগছে লক্ষ লক্ষ শিশু। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা কোটিতে পৌঁছে গেছে। কলেরার প্রকোপে জীবন বিপন্ন প্রায় ১১ লক্ষের।
২০১১-র ‘আরব বসন্ত’র সময়ে ইয়েমেনে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট সালেহ ক্ষমতাচ্যুত হন। নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আবেদ রাব্বো মনসুর হাদি। কিন্তু তাঁর ক’বছরের শাসনেই ইয়েমেন-এর শিয়ারা সরকারের বিরুদ্ধে জাতিগত নিপীড়নের অভিযোগ তোলে।
২০১৪ সালে বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের তদানীন্তন রাজধানী দখল করে নিলে সরকার ও হুথি বিদ্রোহীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইয়েমেনে বোমাবর্ষণ শুরু করে সৌদি আরবের বিমানবাহিনী। সঙ্গে যোগ দেয় সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কাতার, কুয়েত, জর্ডান-এর মতো বেশ কয়েকটি দেশের বায়ুসেনাও। এই হামলায় হাজার হাজার সাধারণ ইয়েমেনি নাগরিক মৃত্যুবরণ করে। ঘরহারা হন বহু মানুষ। রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং যুদ্ধবিশেষজ্ঞদের মতে এই যুদ্ধেই মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়েছে। কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। যুদ্ধর্লিষ্ট দেশে দেখা দিয়েছে চরম দুর্নীতি এবং বিশৃঙ্খলা।