শরীয়তপুর অন্ধ

দৃষ্টিহীনতার প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই তারা হয়েছেন আইনজীবী, শিক্ষক, গায়ক ও বংশীবাদক। অর্জন করেছেন মানুষের ভালোবাসা আর জনপ্রিয়তা

দৃষ্টিহীনতা তাদেরকে দমাতে পারেনি। চোখে আলো না থাকা সত্ত্বেও নিজেরা যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তেমনি সমাজের জন্যও রাখছেন উল্লেখযোগ্য অবদান। বলা হচ্ছে শরীয়তপুরের ৪ জন মানুষ আমির হোসেন, আব্দুল মালেক, বিল্লাল হোসেন আর রফিক মুন্সীর কথা। জেলার অনেকের কাছেই তারা এখন অনুপ্রেরণার নাম।

এদেরমধ্যে আমির হোসেন পেশায় একজন আইনজীবী। শরীয়তপুর জজ কোর্টে নির্যাতিত নারী আর প্রতিবন্ধীদের মামলা বেশি লড়ে থাকেন। পেশাগত সাফল্যের জন্য বেশ সুনাম রয়েছে দৃষ্টিহীন এই আইনজীবীর।

আমিরের বাড়ি জেলার জাজিরা উপজেলার জব্বর আলী আকনকান্দি গ্রামে। সাড়ে তিনবছর বয়সে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি অন্ধত্ব বরণ করেন। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের এই মানুষটি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী। পড়াশোনার প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। তবে তখন প্রতিবন্ধীদের জন্য পড়াশোনা করা অনেক কঠিন ছিল। তবুও দমে যাননি আমির। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে আইন সাফল্যের সঙ্গে স্নাতক ও স্নাতকোত্তোর ডিগ্রি অর্জন করেন।

পড়াশোনা শেষ করে তিনি চাকরি নেন অসহায় নারী ও শিশুদের  নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও)। সেখানে তিনি সমাজের মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তিনি বুঝতে পারলেন অসহায় দরিদ্ররাই আইনি সেবা থেকে বঞ্চিত। এনজিও ছেড়ে নেমে পড়লেই আইনপেশায়। জাতীয় বার কাউন্সিলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিজ জেলা শরীয়তপুরের আদালতে কাজ শুরু করেন আইনজীবী। অর্থাভাবে আইনি সহায়তা বঞ্চিত ও প্রতারিত মানুষদের সেবা দিতেই এই পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তিনি।

আইনজীবী আমির হোসেন ঢাকা ট্রিবিউন

আমির হোসেন বলেন, নিজেকে মেলে ধরার মাধ্যমে সমাজের প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে দৃষ্টান্ত হওয়া এটা আমার ব্রত ছিল।

এবার আসা যাক শিক্ষক আব্দুল মালেকের গল্পে। নড়িয়া উপজেলার উত্তর কেদারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি। স্কুলে ঢুকে প্রথমেই তিনি ল্যাপটপ কম্পিউটারে নিজের পাঠদান সূচি ঠিক করে নেন। এরপর ঢোকেন শিশু শ্রেণিতে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আদর আর মমতা দিয়ে পড়ানোর মধ্যদিয়ে দিন শুরু হয় তার। এরপর নেন চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস। সবশেষে সংগীতের ক্লাস। নিষ্ঠার সঙ্গে এতসব করছেন যে মানুষটি, তার চোখে আলো নেই। তাতে কী? শিক্ষার আলো ছড়াতে তো আর বাধা নেই! জনপ্রিয় এই শিক্ষকও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি গানের গলাও ভালো আব্দুল মালেকের। সঙ্গে রয়েছে প্রযুক্তিগত দক্ষতা। জানেন হস্তশিল্পের কাজও। এক কথায় তিনি বহুগুণে গুণান্বিত একজন মানুষ।

শিক্ষক আব্দুল মালেক ঢাকা ট্রিবিউন

আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে শিক্ষক আব্দুল মালেক বলেন, নিজেকে কখনও প্রতিবন্ধী মনে করিনি। বরং এই প্রতিবন্ধকতাকে শক্তি মনে করে আরও দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে চলেছি। দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছি সমাজের ওইসব প্রতিবন্ধীদের মাঝে যারা নিজেকে অজুহাতের বেড়াজালে আটকে রেখেছেন। তাই শিখেছি গান, হাতের কাজ আর নিয়েছি উচ্চশিক্ষা। এখন আমার অর্জিত গুণ সমাজে ছড়িয়ে দিতে চাই।

জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন আরেকজন মানুষ শরীয়তপুর সদর উপজেলার দাসার্তা গ্রামের বিল্লাল হোসেন। পড়াশোনা করছেন পিকেএস নামে একটি বেসরকারি প্রতিবন্ধী স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই সুরের প্রতি ছিল প্রবল টান। গান শিখেছেন শরীয়তপুর শিল্পকলা একাডেমিতে। কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলেও গান করে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিল্লাল হোসেন।

কণ্ঠশিল্পী বিল্লাল হোসেন ঢাকা ট্রিবিউন

কণ্ঠশিল্পী বিল্লাল হোসেন বলেন, প্রতিবন্ধীরা যে সমাজের বোঝা নয় সেটাকে আমি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। আমাদেরও রয়েছে সম্মান, অধিকার ও প্রতিভার বিকাশের সুযোগ। আমাকে দেখে অনেকেই এখন হতাশা ছেড়ে ঘুরে দাড়িয়েছেন। আমার স্বপ্ন ভবিষ্যতে আরও বড় শিল্পী হবো। গানের মাধ্যমে নিজের আর সমাজের পরিবর্তন ঘটাবো।

শরীয়তপুরেরই আরেকজন গুণী মানুষ রফিক মুন্সী। শিক্ষাগত যোগ্যতায় পিছিয়ে থাকলেও তিনি বাঁশির সুরে মানুষকে মুগ্ধ করে বিক্রি করেন বাঁশি আর চকলেট। শরীয়তপুরের সদর উপজেলার পালং ইউনিয়নের ভুচুড়া গ্রামে জন্ম তার। ৪ বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে অন্ধত্ব বরণ করতে হয় তাকে। ২২ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে আরও অসহায় হয়ে পড়েন এই দৃষ্টি প্রতিবন্ধি মানুষটি।

বাঁশিওয়ালা রফিক ভাই ঢাকা ট্রিবিউন

প্রবল আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন রফিক চেয়েছিলেন আত্মনির্ভরশীল হতে। গ্রামের হাট-বাজারে বাঁশি বাজিয়ে শুরু করেন চকলেট আর বাঁশি বিক্রি করতে। ধীরে ধীরে তিনি পরিচিতি লাভ করেন “বাঁশিওয়ালা রফিক ভাই” নামে। এলাকার সবার সঙ্গে তার হৃদ্যতার সম্পর্ক।

রফিক মুন্সী বলেন, লেখাপড়ার করার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারের পাশে দাঁড়াতে উপার্জনে নামতে হয়েছিল। কাজের মাঝেও আনন্দ খুঁজে পেতেই বাঁশি বাজাতে শুরু করি। এভাবেই আয়ের পথ তৈরি করেছি।