ইতোমধ্যে তরুণ শিল্পী জয়ন্ত মণ্ডল বাংলাদেশের শিল্পরসিক মহল এমনকি সাধারণ্যে পরিচিত হয়ে উঠেছেন তার ‘সময়ের দুর্গতিনাশিনী’ চিত্রকর্মটির মধ্য দিয়ে। এই দুর্গতিনাশিনী আমাদের চেনা। আমাদের দুর্দশাগ্রস্ত সমাজের সাম্প্রতিক বলি- হিন্দু পুরাণের দুর্গতিনাশিনী দুর্গার প্রতীকী আবহে আবির্ভূত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত। জয়ন্ত মণ্ডল সমসাময়িক বাস্তবতার এই চরমতম অভিঘাতকে তার শিল্পচেতনার ভেতর দিয়ে যেন নবরূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এবার শিল্পীর সেই চেতনার বিস্ম্ফোরণ আরও বিস্তৃত, আরও প্রস্ম্ফুটিত হয়ে উপস্থাপিত হয়েছে সম্প্রতি আয়োজিত জয়ন্ত মণ্ডলের প্রথম একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী ‘রোটেশন অব টাইম’-এ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে গত ২৩ থেকে ২৯ জানুয়ারি আয়োজিত প্রদর্শনীতে শিল্পী বললেন সময়ের উল্টো পায়ে হাঁটার তিক্ত বাস্তবতার কথা। সভ্যতার আধুনিকতম সময়ে এসে ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে হেঁটে আবার সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ফিরছি কিনা আমরা- সে প্রশ্নই ছুড়ে দিয়েছেন প্রতিটি শিল্পকর্মের মাধ্যমে।
জয়ন্ত ভাবতে বাধ্য করলেন, ‘উইমেন ইন ডেঞ্জার’ কথাটি এখনও বাস্তব। বরং ক্রমাগত নারীর সেই বিপদগ্রস্ততা বেড়েই চলেছে। জিহাদের নতুন রূপ নিয়ে এসেছে সুইসাইড স্কোয়াড। গ্রিক পুরাণের সেই বিখ্যাত চরিত্র হারকিউলিস ফিরে এসেছে প্রতিশোধপরায়ণ গুপ্ত ঘাতকের বেশে। জয়ন্তর চিত্রকর্মে সে হারকিউলিস উপস্থিত হয়েছে লুঙ্গি পরে।
বেশিরভাগ চিত্রকর্মেই দাঁড়িপালল্গাকে বিষয় হিসেবে এনেছেন শিল্পী। সামাজিক অনৈতিকতা এবং আইনের মানদণ্ডকে বারবার টেনেছেন। অর্থাৎ ইমব্যালেন্সিং ব্যালেন্স করার প্রবণতা। সাবজেক্টকে রেডিমেড আর্টের মতো ডিকন্সট্রাক্ট করলেও নব্বইয়ের দশক থেকে শিল্পভাবনার যে কন্ট্রোভার্সিয়াল রূপ দেখা গেছে, জয়ন্ত মণ্ডলের শিল্পকর্মও অনেকটা সেই ইঙ্গিত প্রকাশ করে। ভারতীয় শিল্পের প্রকৃতিকেন্দ্রিক দর্শনের খানিকটা নির্যাস আছে।
নুসরাত হত্যার দ্রুত বিচার হয়েছে এবং এই সুবিচারের বিকাশকে তিনি ভারতীয় ক্ল্যাসিক্যাল যুগের মতো পদ্মের মাধ্যমেই বুঝিয়েছেন, আশা জাগ্রত। অন্যভাবে চিন্তা করলে ধর্ষণের মতো একটি ঘৃণ্য অপরাধ যেভাবে ডালপালা বিছিয়ে চলেছে, পদ্মের শিকড়গুলো সেই ভাবনাকেও নতুন করে ভাবাতে চাইছে। প্রকৃতিকেন্দ্রিক প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের শুভ-অশুভ শাসনের দ্বন্দ্ব্ব অনেকাংশে প্রতীয়মান পানির নিচে রাখা নুসরাতের প্রতিকৃতির ওপর শিকড় ছড়ানো পদ্মের সঙ্গে। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক যৌনতার বিষয়টি। কপালে আঁকা বিয়ের চন্দন প্রতিটি নারীর সারাজীবনের একান্ত আরাধ্য। ধর্ষণের শিকার কেবল শরীর নয়, মূল্যবোধ ও স্বপ্ন।
এ প্রদর্শনীকে আলাদাভাবে দেখার সুযোগ এখানেই। আলো-ছায়ার বৈচিত্র্য আর মাধ্যমের দিক থেকে এটি সত্যিই ভিন্নতার দাবিদার। শিল্পী তার একান্ত চিন্তাগুলোকে চারকোনা ক্যানভাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং দ্বিমাত্রিক চিত্রকে অনেকটা ত্রিমাত্রিক বাস্তবতায় এনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। সেখানেই সৃষ্টিশীলতা যুক্ত করেছে আলো-ছায়া। ‘আনুষ্ঠানিক নৃশংসতার আখ্যান’ শিরোনামের চিত্রটিতে দ্বি-মুখাকৃতির বোর্ডটিতে আলো ফেলার কারণে যে ছায়ার জন্ম হয়েছে, সেটিই মূলত এর নামের সার্থকতা। ধর্মীয় বিকৃত আচার-সংস্কৃতির চর্চা মানুষের মস্তিস্কে স্বাভাবিকতা পেয়ে গেছে। কিন্তু দেয়ালের নির্বিকার ছায়া আমাদের ভাবনার পেছনের স্থবিরতাকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। ধর্ম, নৃশংসতা, হত্যার পরও কি আমরা স্থবিরতা থেকে মুক্তি পাচ্ছি? তবে হার্ডবোর্ডের মাধ্যমে প্রথিত বিষয়বস্তুকে অপেক্ষাকৃত জোরালোভাবে দৃষ্টিগোচরতা থেকে বাইরে আনতে পেরেছেন বলে দাবি করছেন শিল্পী। ইওরোপীয় পোস্টমডার্ন রীতির স্বতঃস্ম্ফূর্ত প্রভাব বলা যেতে পারে এই দ্বিমাত্রিক থেকে ত্রিমাত্রিক করার প্রবণতাকে। সামান্য অথবা চৌকোনাকৃতির ক্যানভাসে সীমাবদ্ধ না থেকে হার্ডবোর্ডকে চিত্রের বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতার সঙ্গে সমন্বয় করে আকৃতি দান করেছেন জয়ন্ত।
জয়ন্তের শৈল্পিক দূরদর্শিতা প্রদর্শনীর প্রতিটি চিত্রকে ছাপিয়ে গেছে। প্রাচীনতা থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত চলে আসা প্রতিটি ভারতীয় শিল্প রীতির সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হওয়ার বিষয়টি তার দর্শন ও শিল্প ভাবনাকে সফলভাবে ছুঁতে পেরেছে বলা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সবার আগে চোখে পড়ে প্রদর্শনীর প্রতীক বা প্রচ্ছদ হিসেবে জায়গা করে নেওয়া ‘সময়ের দুর্গতিনাশিনী’ শিরোনামের চিত্রকর্মটি। স্বদেশী আন্দোলনের সময় ভারতীয় আধুনিক শিল্পরীতির প্রবাদপুরুষ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁকেছিলেন ‘ভারত মাতা’ (১৯০৫ সাল) শিরোনামের একটি চিত্র। যেখানে একজন নারীকে হিন্দু ধর্মীয় ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান করতে শিল্পী একাধিক হাত ব্যবহার করেছেন। হাতের প্রতিটি অবজেক্ট কুড়ির দশকের ভারতীয় অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক অবস্থাকে বুঝিয়েছে। ভারতীয় তথাকথিত রেনেসাঁ যুগের এই চিত্রের মতোই জয়ন্তর আঁকা ছবিতে দুর্গার হাতিয়ারগুলো দেবতাগণ ফিরিয়ে নিয়েছেন নিজেদের স্বার্থে। পিরামিড কম্পোজিশনের চিত্রটিতে শিল্পের আদর্শবাদ থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গাকে সাধারণ নারী রূপে দেখাতে চেয়েছেন, যে বিচারের দাবিতে মরিয়া। তার হাতের প্রতিটি মুদ্রা প্রতিরক্ষার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ভরতনাট্যমের বিভিন্ন মুদ্রা ধারণ করেছে। পরক্ষণেই অন্য একটি চিত্রে নারীকে অস্ত্র হাতে নিজের বিচার নিজেই করার ক্ষমতা অর্জন করতে দেখা যাচ্ছে। আর এখানেই শিল্পী নিজের বক্তব্যে সমাধানের সন্ধান দিয়েছেন- শিক্ষাই পারে নারীকে বিশ্বায়নের যুগে কুপ্রথামুক্ত করতে।
সময়ের জড়তা ভেঙে উঠে আসতে চাইলেও পারতপক্ষে দর্শনগত দিক থেকে জয়ন্তর আঁকা ফিগারগুলোর অনেকাংশেই যে কারণে স্থবিরতাকে সামনে আনছে, তা হলো বিশ্বাস। সম্পূর্ণ হয়েও অসম্পূর্ণতা লক্ষণীয়। তিনি জানালেন, মৌলবাদের বিশ্বাস মানুষকে এতটাই অন্ধ করে দিয়েছে যে, তা শ্যাওলা কিংবা গাছের শিকড়ের মতো মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে গেঁথে গেছে। চাইলেও এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। স্যুরিলিস্ট রীতির এই চিত্রগুলো অ্যাক্রিলিকের বাদামি রঙের সঙ্গে আরও বেশি অর্থবহ হয়েছে। রং ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ভারতীয় ধ্রুপদি রীতিকে তিনি ত্যাগ করতে পারেননি ভারতীয় রেনেসাঁ শিল্পীদের মতোই। আবার দেশপ্রেম কিংবা মানবিক ভাবনার দিক থেকেও তিনি স্থানীয় অগ্রজ শিল্পীদের পথই অবলম্বন করেছেন। কাঁটাতারের কাছে মানবিকতার জয়-পরাজয়কে তিনি সমদৃষ্টিতে দেখাতে চাইলেও এটি অনেকটা স্যাটায়ার হিসেবেই দেখিয়েছেন। একইভাবে জলরংয়ে আঁকা ‘সার্চিং ফর স্কোয়াড’ শিরোনামের চিত্রে ধর্মের অধর্ম দিকগুলো তুলে ধরেছেন। জয়ন্ত মণ্ড নতুন করে ভারতীয় শিল্প ও দর্শন রীতিকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা এ সময়ে এসে অনেকটাই বিরল। পাশাপাশি ইওরোপীয় রীতিকেও তিনি অগ্রাহ্য করেননি। বরং দেশীয় স্থানীয় শিল্প ভাবনাতে আবার জোর দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেছেন। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরও যখন বাংলাদেশে কোনো শিল্পরীতির জন্ম হয়নি বলে ধরে নেওয়া যায়, তখন জয়ন্ত মণ্ডলের মতো শিল্পীই আবার নতুন করে ভাবতে শেখান। যদিও তিনি জানালেন, একাডেমিক নিষেধাজ্ঞার কারণে গ্যালারির দেয়ালকে মনের মতো রং করে নেওয়া কিংবা লাইটিংয়ের বিষয়কে সেভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। আশা করছি, ভবিষ্যতে তাকে এমন অসহযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে না। শিল্পীর মনের ভাব প্রকাশের যথাযথ সহযোগিতাই কাম্য একেকটি প্রদর্শনীতে। ভারতীয় প্রকৃতি দর্শনের প্রভাব সমগ্রটাজুড়ে বোঝালেও সম্পূর্ণ প্রদর্শনীতে তাকে উহ্য রেখেছে সফলভাবে নন্দনতাত্ত্বিক সত্তাকে বজায় রেখে। যেটি সময়ের দাবি হলেও বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া অনেক প্রদশর্নীতেই খুব একটা চোখে পড়েনি। অসময় বা শিল্পীর ভাষায় সময়ের এই উল্টো যাত্রায় একটি আশাবাদী প্রদর্শনী ‘রোটেশন অব টাইম’।