Forex Trading এর মাধ্যমে প্রতারণা করে শত কোটি টাকা আত্মসাৎকারী একটি সংঘবদ্ধ চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম।
ডিজিটাল যুগে জালিয়াত চক্রের থাবায় দেশের নোয়াখালী, কুমিল্লা, সাভার, গাইবান্ধা ও দিনাজপুরের জেলা থেকে শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এরা। প্রতারক চক্রটি এসব অঞ্চলের প্রায় ৫ হাজার ৪শ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে।
এই প্রতারক চক্রের দ্বারা প্রতারিত হয়ে একজন ভিকটিম গত ৪ সেপ্টেম্বর কদমতলি থানায় মামলা দায়ের করলে সংঘবদ্ধ এই গ্রুপের ৩ সদস্যকে ঢাকার কলাবাগান, ধানমন্ডি ও পল্টন থেকে সিআইডি অর্গানাইজড ক্রাইম এর বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল এর তত্ত্বাবধানে সিনিয়র পুলিশ সুপার মো. মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার এর নেতৃত্বে একটি টিম গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারকৃত আসামি ৩ জনই নোয়াখালীর ভিন্ন ভিন্ন থানার বাসিন্দা। নোয়াখালী সদর থানার মো.জয়নুল আবেদিন ও নূর জাহান বেগমের ছেলে জাহাঙ্গীর কামাল চৌধুরী, সেনবাগ থানার কাজীরখিল গ্রামের সন্তোষ কুমার ভৌমিক ও জ্যোৎস্না রানী ভৌমিকের ছেলে রাজীব কুমার ভৌমিক এবং সদর থানার মাইজদী গ্রামের মিন্টু কুমার ভৌমিক ও কাজল প্রভা রানী ভৌমিকের ছেলে সজিব কুমার ভৌমিক। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর কদমতলী থানায় বৃহস্পতিবার (৬ সেপ্টেম্বর) অর্থ প্রতারণার মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
অর্গানাইজড ক্রাইম, সি আই ডি, বাংলাদেশ বৃহস্পতিবার (৬ সেপ্টেম্বর) প্রতারণার বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমকে জানায়।
সি আই ডির তথ্যে উঠে আসে তাদের প্রতারণার নাটকীয় কাহিনী…
আপনি স্মার্ট, উচ্চ শিক্ষিত, স্বচ্ছল এবং দুনিয়া সম্পর্কে সব জ্ঞান রাখেন। মানুষ আপনাকে মান্য করে। রাজনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে সর্ব সাম্প্রতিক তথ্যও আপনার জানা আছে। অফিসে আপনার পদও বেশ উঁচু। একদিন আপনার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর বন্ধুর পরিচিত অতি আধুনিক এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হলো, যিনি আপনার মতই উচ্চ শিক্ষিত, স্মার্ট এবং টেকনোলোজিক্যালি দক্ষ।
কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন যে, একটি নতুন ব্যবসা এসেছে যেখানে ঘরে বসে কম্পিউটারের মাধ্যমে অনলাইনে অল্প কিছু টাকা ইনভেস্ট করে বেশ ভালো উপার্জন করা সম্ভব। পরিচিত কয়েকজনের উদাহরণ টেনে জানালেন তারা বিনিয়োগ করে এতই লাভবান হয়েছে যে চাকরি ছেড়ে এখন ফুলটাইম এই ব্যবসা করছে। কিন্তু আপনি তো আর যাচাই না করে তা বিশ্বাস করার পাত্র নন। প্রথমে তাদের সাথে কথা বললেন। গুগলে গিয়ে দেখলেন ঘটনা তো সত্য! (www.tradestation.com) ধরনের একটা সাইটের সাহায্যে সারাবিশ্ব থেকে হাজার হাজার মানুষ আন্তর্জাতিক শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছে, লাভবানও হচ্ছে। আপনি আরও কিছু সাইটে গিয়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পেলেন। অনেক বিনিয়োগকারীর রিভিউ, সাকসেস স্টোরি পড়ে বিষয়টি চেক করে নিলেন। সাথে সাথে ভাবলেন আপনারও বিনিয়োগ করার মত কিছু টাকাতো আছে। দেশের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতেও চাচ্ছিলেন কিন্তু ধ্বসের ভয়ে আর এগোননি।
বিষয়টি পরিবারেও শেয়ার করলেন, এক পর্যায়ে সম্মতি ও পেয়ে গেলেন কারণ আপনি তো অনেক সচেতন একজন মানুষ। আপনি যেটা লাভজনক ভাবছেন তা অবশ্যই ভালো বলে পরিবারে সবাই মানে। আপনি সেই প্রস্তাবকারী ভাইকে কল দিলেন এবং বললেন যে বর্তমান বেতনে চলা একটু কঠিন হয়ে পড়ছে যদি চাকরির পাশাপাশি একটা ব্যবসা করা যেত, যাতে কোন দৌড়াদৌড়ি করা লাগে না।
এবার তিনি আপনাকে ওই আন্তর্জাতিক শেয়ার সাইটে বিনিয়োগ করার কথা বললেন। আপনিও মনে মনে এটা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আপনাকে সব নিয়মকানুন সবিস্তারে জানালেন। আপনাকে কিছুই করতে হবে না, শুধু প্রথমে ঐ সাইটে একটা ইউজার আইডি খুলতে হবে। আইডি খোলার সাথে সাথেই আপনার আইডিতে কিছু বোনাস ভার্চুয়াল কারেন্সি জমা হবে যা বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট নয়।
এবার আপনি নগদ টাকা সেই ভাইকে দিলে তিনি আপনাকে সমপরিমাণ ভার্চুয়াল কারেন্সি কিনে আপনার আইডিতে ট্রান্সফার করেন। এর মধ্যেই একটা সুক্ষ্ম বিচ্যুতি হয়ে গেছে যা আপনার দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। খেয়াল করলেন (www.tradestation.com) এর বদলে আপনি (www.tradestation.info বা .com এর স্থলে .global/.online/.asia/.biz/.org) ইত্যাদির কোনো একটা বসানো আছে।
আপনি খুবই বিচক্ষণ প্রকৃতির লোক বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন করে বসলেন। উত্তরও রেডি ছিল যে, এটা একই সাইটের একটা ব্রোকার হাউজের ভার্শন যেখানে বিশেষ বিশেষ অনেক সুবিধা আছে। আর এই ব্রোকার হাউজটা শুধু বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের নিয়ে ডিল করে। বাংলাদেশ থেকে যারা বিনিয়োগ করে সবাই এখানেই করে। আপনি সবার কাছে খোঁজ নিলেন এবং দেখলেন ঠিক আছে পরিচিত সবাই এটাতেই আছে।
আর ঘাটলেন না, বিনিয়োগ করে ফেললেন। এরপর আপনার কাছে একটার পর একটা বিভিন্ন লোভনীয় ও লাভজনক ব্যবসায়িক প্রস্তাব আসতে লাগল। রবিবারের লটারি ডিলে অংশ নিলে বিজয়ী হলে ২০০ শতাংশ বোনাস, বিজয়ী না হলে ১২০ শতাংশ বোনাস যা আপনার অ্যাকাউন্টে ভার্চুয়াল কারেন্সিতেই যোগ হবে।
অফিসের কাজে এবার আপনার ঢিলে ভাব চলে এসেছে যে, এই বিজনেসে একটু সময় দিলে বা বিভিন্ন পর্বে অংশ নিলে একদিনেই ২৫০-৩০০ ডলার আয় করা যায়। আপনি এবার এই ব্যবসায় আরও মনোযোগ দিলেন। নতুন নতুন আইডি খুলতে লাগলেন। নগদ যেখানে যা ছিল সব এখানে কাজে লাগালেন। একসময় ভাবলেন বাসায় যে গয়নাগাটি অযথা পড়ে আছে তা বিক্রি করে এখানে কাজে লাগাবেন পরে আবার নতুন মডেলের গয়না কিনে নিবেন। আপনি দেখলেন আপনার অ্যাকাউন্টে আপনার আসল আর মুনাফা মিলে প্রায় ৮০-৯০ হাজার বা তারও বেশি ডলার জমা হয়ে গেছে!!!
বিগত কিছুদিন ডলার জমানো আপনার এমন নেশায় পরিণত হয়েছে যে, চাকরিটা ছাড়ি ছাড়ি ভাব চলে এসেছে ভেতরে। হঠাৎ আপনার বড় অঙ্কের টাকা দরকার হয়ে পড়ায় ভার্চুয়াল ডলার নগদায়ন করতে গিয়ে জানলেন নতুন নিয়ম চালু হয়েছে যে, আইডি’র একটা নির্দিষ্ট সময় হবার আগে কোন অ্যাকাউন্টের নগদায়ন করা যাবে না। আবার যখন তোলা যাবে তখন একদিনে সর্বোচ্চ ৫০ ডলারের বেশি ভাঙানো যাবে না। এর কিছুদিন পর এক সুন্দর সকালে দেখলেন সাইটটিতে ঢুকতে চাইলে বারবার ৪০৪ বা ৫০৬ এর ম্যাসেজ আসছে। সেই ভাইকে ফোন দিয়ে শুনতে পেলেন-দুঃখিত, আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না এবং কোনো দিনও হবে না।
আবার নতুন জেলায় নতুন কোন উচ্চ শিক্ষিত স্বচ্ছল নতুন এক সুন্দর সকালে আবার সেই অতি আধুনিক ভদ্রলোকের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পাবে। আর আপনি ভেতরে ভেতরে গুমরে গুমরে মরবেন কারণ আপনি আইনের আশ্রয় নিতে গেলেও সবাই আপনার নির্বুদ্ধিতা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করবে।
তাই এ ধরনের লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে প্রতারিত হবেন না। এই সব প্রতারকরা আপনার-আমার সামনে মুখোশ পরে ভদ্র লোক সেজে ঘুরা ফেরা করে। সুতরাং নিজে সাবধান হোন এবং অন্যকে সাবধান করুন। আর আপনি যদি ইতোমধ্যে এদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে থাকেন, তাহলে সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের সাথে যোগাযোগ করুন।
ইতোমধ্যে এই এই প্রতারক চক্রের দ্বারা প্রতারিত হয়ে একজন ভিকটিম কদমতলি থানায় মামলা রজু করলে এই সংঘবদ্ধ গ্রুপের ৩ সদস্যকে গত ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ঢাকার কলাবাগান, ধানমন্ডি ও পল্টন থেকে সিআইডি অর্গানাইজড ক্রাইম এর বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম, বিপিএম,পিপিএম(বার) এর তত্ত্বাবধানে সিনিয়র সরকারি পুলিশ সুপার মো. মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার এর নেতৃত্বে একটি টিম গ্রেফতার করে।