অনলাইন ডেস্ক : প্রতি বাংলা বর্ষপঞ্জি ঘুরে একবার করে দেখা দেয় বৈশাখ। সে তুলনায় বিশ্বকাপের জন্য অপেক্ষাটা আরেকটু বেশি। চার বছর পর পর দেখা মেলে একটা বিশ্বকাপের। অবশেষে সেই অপেক্ষার প্রহর ফুরালো। চার বছর ঘুরে আবার দুয়ারে এলো বিশ্বকাপ ফুটবল। আবার বিশ্ব মেতে উঠবে এক ফুটবল উন্মাদনায়। আবার দেশজুড়ে শুরু হবে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল নিয়ে উন্মাদনা, উড়বে পতাকা, রাস্তাঘাটে দেখা মিলবে নানান ধরনের জার্সি; কারণ শুরু হচ্ছে আজ থেকে বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপ কেন গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ?
এ নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। অলিম্পিককেও বলা হয় ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপ দাবি করে এই নামের যোগ্য অধিকারী তারাই। একটু অবাক লাগে। কারণ, ৩২টা দলকে নিয়ে এই আয়োজন পৃথিবী নামের গ্রহের সেরা আয়োজন কেন হবে! কারণ, এটা কেবল ৩২ দলের এক টুর্নামেন্ট নয়। এটা ২১১টি দেশের এক টুর্নামেন্ট।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি। ফিফার সদস্য সংখ্যা জাতিসংঘের চেয়েও অনেক বেশি। জাতিসংঘের এখন সদস্য ১৯৩টি দেশ। সেখানে ফিফার সদস্য ২১১টি দল। আর এই ২১১টি দল নিয়েই কয়েক বছর আগে শুরু হয় প্রকৃত বিশ্বকাপ। বাছাইপর্ব নামে খেলা চলতে থাকে। আর যে বিশ্বকাপ আজ থেকে রাশিয়ায় হবে, ফিফার ভাষায় সেটা ‘ফাইনালস’। মানে, বিশ্বকাপ কেবলই এই একমাসের একটা আয়োজন নয়। এটা কয়েক বছর ধরে চলতে থাকা এক উত্সব। এই উত্সবের ভাগীদার আমাদের দেশও, এই উত্সবের ভাগীদার আমি-আপনি সকলে।
তারপরও একটা প্রশ্ন প্রায়শ শোনা যায়, কেন বিশ্বকাপ নিয়ে এতো মাতামাতি?
এই প্রশ্নটার এক কথায় জবাব দেওয়া কঠিন। তবে এটা মানতে হবে যে, বিশ্বকাপের মতো আবেগ তৈরি করা আয়োজন দুনিয়ার ইতিহাসে আর আসে না। এটা কেবল মাঠের খেলা নয়। এটা মাঠের বাইরে ও মাঠে হাসি-কান্নার এক বিশাল আয়োজন। বিশ্বকাপের এই মহিমা যে, এটা খেলোয়াড়দেরও ঠেলে দেয় পেশাদার দুনিয়ার ওপরে কোথাও।
এই বিশ্বকাপ আসরেই দেখা যায় দুই প্রিয় বন্ধু ওয়েইন রুনি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জাতীয় দলের স্বার্থে ‘শত্রু’ হয়ে উঠেছেন। এখানে মানুষ ক্লাবের আজীবনের ইতিহাস ভুলে যায়। কেবলই সামনে থাকে জাতীয় দলের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের জন্য খেলোয়াড়রা ক্যারিয়ারকে বাজি ধরতেও দ্বিধা করেন না। সেই গত বিশ্বকাপের লুই সুয়ারেজের কথা চিন্তা করুন। গোলরক্ষক পরাস্ত; বল ঢুকে যাচ্ছে জালে। নিশ্চিত লালকার্ড ও নিষেধাজ্ঞা জেনেও সুয়ারেজ বল হাত দিয়ে ধরে ফেললেন। এই দৃশ্য বিশ্বকাপ ছাড়া আর কোথায় পাবেন!
আসলে ফুটবল খেলাটার চরিত্রই এমন।
এই খেলা খেলতে লাগে না হাজার হাজার টাকার উপকরণ, নেই আইন-কানুনের ভুরি ভুরি খটমটে কথা। আছে কেবল সরল সোজা গোলের উত্সব এবং পাওয়ার আনন্দ ও না পাওয়ার বেদনা। তাই এই খেলা সারা পৃথিবীকে একটা সুতোয় বেঁধে ফেলতে পারে। আর সেই খেলার বিশ্বকাপ যখন, তখন সেই সুতোটা আরও শক্ত হয়ে পৃথিবীর সব মানুষকে আঁটোসাঁটো করে বেঁধে ফেলে।
ফুটবলারদের জন্য বিশ্বকাপটা আরও গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এখানে তারকা থেকে মহাতারকা হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে। বিশ্বকাপই একজন পেলে কিংবা ম্যারাডোনাকে অসাধারণ করে তোলে। একটা বিশ্বকাপের স্পর্শ একজন তারকাকে করে তোলে পূর্ণাঙ্গ।
লিওনেল মেসির কথা ধরুন। সারাটা ক্যারিয়ার বার্সেলোনায় কাটানো লিওনেল মেসি ক্লাবের হয়ে জেতেননি এমন কিছু নেই। পাঁচবার ফিফা বর্ষসেরা ও পাঁচবার ব্যালন ডি’অর জিতেছেন। বার্সেলোনার হয়ে ৩২টি ট্রফি জিতেছেন। এর মধ্যে আছে ৯টি লা লিগা, চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ছয়টি কোপা দেল রে। লা লিগায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। এ ছাড়াও লা লিগায় এক মৌসুমের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ইউরোপে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলদাতা, ইউরোপে এক বর্ষপঞ্জিতে সর্বোচ্চ গোলাদাতা; ভুরি ভুরি রেকর্ড তার দখলে। জাতীয় দল আর্জেন্টিনার ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা মেসি। জাতীয় দল ও ক্লাবের হয়ে ছয় শতাধিক গোল করেছেন।
কিন্তু মেসি কী এই সবকিছু নিয়ে তৃপ্ত? মেসি নিজেকে কী ভিনগ্রহের ফুটবলার বলে ভাবতে পারেন? উত্তর-না। কারণ, তার জীবনের সবচেয়ে বড় অতৃপ্তিটা হলো জাতীয় দলের হয়ে কোনো মেজর ট্রফি জিততে পারেননি। যুবদলের হয়ে জিতেছেন, অলিম্পিক জিতেছেন; কিন্তু আর্জেন্টিনা মূল দলের হয়ে কিছু জেতা হয়নি। গত বিশ্বকাপে নিঃশ্বাস ফেলা দূরত্ব থেকে ফিরে এসেছেন। মাঝে অবসরও নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু একটা বিশ্বকাপ জিতবেন বলে ফিরে এসেছেন। এই ক’দিন আগেও বলেছেন, একটা বিশ্বকাপের জন্য ক্লাবের হয়ে জেতা সব শিরোপা ফেরত দিয়ে দিতে পারেন।
এই বিশ্বকাপ এমনই এক ব্যাপার।
অবশেষে আমরা সেই বিশ্বকাপের দুয়ারে দাঁড়িয়ে। এই প্রথম রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ। ২০১০ সালে তারা এই আয়োজনের স্বত্ব পেয়েছে। সেই থেকে চলছে তোড়জোড়। আজ থেকে শুরু হয়ে আগামী ১৫ জুলাই পর্যন্ত চলবে এই আসর। রাশিয়ার ১১টি শহরের ১২টি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে ৩২ দলের মোট ৬৪টি ম্যাচ। আর শেষ ম্যাচে বিশ্ব খুঁজে পাবে নতুন চ্যাম্পিয়ন।
চলুন তাহলে ভেসে পড়া যাক বিশ্বকাপের আনন্দে।