অনলাইন ডেস্ক : বজ্রপাতের সঙ্গে ভারী বর্ষণের কারণে চলতি মাসে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দুর্যোগের পূর্বাভাস মিলছে। বজ্রপাতে প্রাণহানিও ঘটছে বেশ। কিন্তু ভারী বর্ষণের ফলে নতুন করে যুক্ত হয়েছে পাহাড় ধসের আশংকা। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিষয়টি মাথায় রেখে প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে।
কালবৈশাখীর সঙ্গে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম এখন বজ্রপাত। আবহাওয়া অফিস বলছে, বৈশাখের সামনের দিনগুলোতে বাড়তে পারে ঝড় এবং বজ্রপাত। গবেষণার তথ্য বলছে, বছরে বজ্রপাতে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কখনো বা ৫০ শতাংশ মানুষই মারা যাচ্ছে মে মাসে। তাই মে মাসে বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। আকাশের গর্জন আর হুঙ্কার, কখনো কখনো বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিকট গর্জন করে নেমে আসা বজ্রপাতে ঘটছে আকস্মিক মৃত্যু। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একটি গবেষণা বলছে, গত আট বছরে দেশে বজ্রপাতে মারা গেছেন ১৮ শতাধিক মানুষ, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩০১জন মারা গেছেন ২০১২ সালে। গবেষণার পরিসংখ্যান বলছে, মে মাসেই ঘটছে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি। তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে বজ্রপাতে ২৬১জনের মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে ১৩২টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে মে মাসে, অর্থাত্ বৈশাখের শেষ সময়ে। এখন সেই ঝুঁকি আরো বেড়েছে, বলছেন গবেষকরা। রয়েছে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসও।
ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘এপ্রিল ও মে মাসে সবচেয়ে বেশি কালবৈশাখী হয়ে থাকে আমাদের দেশে। এই মাসে ঝড়, বজ্রপাত, বৃষ্টি এগুলো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে সারা দেশেই। এখন ঝড় হলেই বৃষ্টি হবে, শিলাবৃষ্টি হবে, বজ্রপাত হবে।’ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে- গত ২৯ ও ৩০ এপ্রিল দুইদিনে ৩২জন লোক বজ্রপাতে মারা গেছেন। গত বছরের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত বজ্রপাতে ২২জন মারা যান। তবে ডিজাস্টার ফোরাম নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাব মতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সারাদেশে বজ পাতে মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৭২২জন। এরমধ্যে ২০১০ সালে ১২৩ জন, ২০১১ সালে ১৭৯জন, ১২ সালে ৩০১জন, ১৩ সালে ২৮৫জন, ১৪ সালে ২১০জন, ১৫ সালে ২৭৮জন এবং ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৩৫০জন নিহত হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ও জলবায়ু বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক নঈম গওহর ওয়ারা ‘ইত্তেফাক’কে বজ্রপাতের বিষয়ে সতর্কতামূলক বেশ কিছু পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, এখন থেকে পরবর্তী তিন মাস (আগামী জুলাই পর্যন্ত) বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। গত ছয় বছরের তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর ১১৭জন মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। গত সাত বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে, সঙ্গে মৃত্যুর হারও বাড়ছে। এ সময়ের মধ্যে চলতি বছরের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজার ৭৪৪জন ব্যক্তির বজ্রপাতজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে।
যে কারণে বজ্রপাত:বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণায় বলা হয়েছে ‘ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আট হাজার থেকে ১০ হাজার মিটার ওপরে উষ্ণ, আর্দ্র বাতাসের বড় একটি অংশ বাংলাদেশের ওপরের বায়ুমণ্ডলের স্তরটা দখল করে ফেলছে। একই অংশে নিচের বায়ুমণ্ডলের স্তরটা কিন্তু ঠান্ডা। মে মাসের দ্বিতীয়, তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এ ধরনের দুটি বাতাসের বা এয়ারমাসের অবস্থান একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে এখানে বজ্রপাতের তৈরির পেছনে। এ বছরের জুন, জুলাই, আগস্টের তাপমাত্রার পরিমাণটা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি হবে। এই তাপমাত্রার সঙ্গে বজ্রপাত বৃদ্ধির একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। এ বছর বজ্রপাতের সংখ্যা, বজ্রপাতের ফ্রিকোয়েন্সি, ইনটেনসিটি সবকিছুই বাড়বে।’ বজ্রপাতে সৃষ্ট তাপমাত্রাও এখন দুই হাজার ডিগ্রি বেড়ে পৌঁছেছে ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে এবং ৫০ কিলোভোল্ট বেগে আছড়ে পড়ছে ৩৫০ কিলো ভোল্ট শক্তি নিয়ে। দেশের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, বরিশাল সদর এবং সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারের উত্তরাংশ বেশি বজ্রপাতপ্রবণ উল্লেখ করে গবেষকরা বলছেন, বজ্রপাতে প্রাণহানির ৯৩ শতাংশই হচ্ছে গ্রামীণ জনপদে। তার মধ্যে উন্মুক্ত স্থানে মারা যাচ্ছে ৮৬ শতাংশ মানুষ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় অবশ্য পাহাড় ধস, জলোছ্বাস ও বন্যাজনিত কারণে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। বজ্রপাতজনিত দুর্যোগের ক্ষেত্রে জনসচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। তবে গত বছর ভিয়েতনাম থেকে বজ্রপাত নিরোধকারী ও আগাম সংকেত প্রদানযোগ্য যন্ত্রাংশ আনার প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলা হলেও তা এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। যেসব কর্মকর্তাকে ভিয়েতনাম থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছিল তারা কোথায় কি বরছেন সে খবরও নেই মন্ত্রণালয়ে।
মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল গতকাল সোমবার ইত্তেফাককে বলেন, গত ২২ থেকে ২৫ এপ্রিল পাহাড় অধ্যুষিত তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার জেলায় দুর্যোগ মন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সফর করেছেন। বিশেষ করে যেসব পাহাড়ি এলাকায় রোহিঙ্গারা বসবাস করছে সেই এলাকা নিয়ে করণীয় সম্পর্কে তারা প্রশাসন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বসবাসকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগামী ১৫ মের মধ্যে সকল অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বলা হয়েছে। গতকাল সোমবার সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সচিব বৈঠক করেন। ্এতে সিদ্ধান্ত হয় আগামী ১৯ এপ্রিল পাহাড়ে তিন বাহিনীর সমন্বয়ে দুর্যোগের সময় উদ্ধার সম্পর্কিত বিষয়ে যৌথ মহড়া হবে।