মাশরাফি, বাংলাদেশ, ক্রিকেট

“আমি কি চুরি করেছি? আমি কি চোর?”

“আত্মসম্মান বা লজ্জার কথা কেনো আসবে, আমি চোর? আমি কি চুরি করি মাঠে? মাঠে এসে উইকেট না পেলে আমার লজ্জা লাগবে কেনো?”

এই কথাগুলো বাংলাদেশের ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়ে আসছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের আগে মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার সংবাদ সম্মেলনের পর থেকেই।

সিলেটে আজ শুরু হয়েছে ওয়ানডে সিরিজ যেখানে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে তিনটি ম্যাচ খেলবে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ শুরু হওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা অনেকটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।

সাংবাদিকের প্রশ্নটি ছিল হুবহু এমন, ”ক্যাপ্টেন, বিষয়টা শেষ পর্যন্ত আসলে যে প্রশ্নগুলো এখন আপনার কাছে আসে অনেকটা আত্মসম্মানের এবং যে জায়গাটায় এখন দাঁড়িয়ে আছেন, বিশেষ করে খারাপ ফর্ম, অবসর, আপনার উইকেট নেই। তো ২০০১ সালে যখন শুরু করলেন, নভেম্বরে, টেস্ট দিয়ে শুরু করলেন, ওয়ানডে খেললেন। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে দিয়েই শুরু হয়েছিল। তারপর যতদূর মনে পড়ে ২০০৭/২০০৮ ৩ম্যাচ ৪ম্যাচ আপনি কোনো উইকেট পাননি। কিন্তু ফিরে এসেছিলেন। এ পরিস্থিতিতে আপনি কখনও পড়েননি। আসলে অপনেন্ট টা জিম্বাবুয়ে বলেই কি একটা এক্সট্রা মোটিভেশান, আপনার যদিও মোটিভেশান দরকার পড়ে না……”

এই প্রশ্নের পরপরই মাশরাফী সেই উত্তরটি দেন যেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রিকেটভক্তরা পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা করছে।

কিন্তু মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার খেলা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে বিতর্কের শুরু এখানে নয়।

২০০১ সাল থেকে মাশরাফী বিন মোত্তর্জা বাংলাদেশ দলে খেলছেন।

বাংলাদেশের হয়ে ৩৬টি টেস্ট ম্যাচ, আজকের ম্যাচসহ ২১৮টি ওয়ানডে ম্যাচ এবং ৫৪টি টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন মাশরাফী।

যার মধ্যে ২০০৯ সালের পর আর তিনি টেস্ট খেলেননি, ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার মাটিতে টি টোয়েন্টি ক্রিকেট আর খেলবেন না বলে ঘোষণা দেন মাশরাফী।

এর আগে পরে নানা সময়ে মাশরাফী কবে ক্রিকেট ছাড়বেন এমন প্রশ্ন এসেছে বহুবার, বহুভাবে।

২০১১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে ক্রিকেট বিশ্বকাপে দলে জায়গা না পেয়ে মাশরাফী ক্যারিয়ারে একটি বড় ধাক্কা খান।

কিন্তু সেটা পাশ কাটিয়ে ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল মাশরাফীর নেতৃত্বে সফর করে এবং বলা হয় বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সফল বিশ্বকাপ ছিল ২০১৫ সালেই।

সে বছর বাংলাদেশ বিভিন্ন ফরম্যাটে ভালো ক্রিকেট খেলে এবং মাশরাফী দলনেতা হিসেবে অন্যরকম এক উচ্চতায় পৌঁছে যান।

২০১৬ সালেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ক্রিকেট সিরিজে বড় ভূমিকা পালন করেন মাশরাফী। শুধু অধিনায়ক হিসেবে না সেবার বল ও ব্যাট হাতে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচও হন তিনি।

কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে আর মাশরাফী ক্রিকেটে দলে ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

২০১৭ সালে মাশরাফীর বোলিং গড় ছিল ৪৯। ৬৪৪ রান দিয়ে তিনি ১৩ উইকেট নেন।

২০১৮ সালে ২৬ উইকেট নেন মাশরাফী, এই বছর মূলত মাশরাফী ভালো করেন তিন ম্যাচে একটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রভিডেন্সে ৩৭ রানে চার উইকেট, আরেকটি এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে ১০ ওভারে ৩৫ রান দিয়ে এক উইকেট, আরেকটি ঢাকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩০ রানে তিন উইকেট।

২০১৯ সালে মাশরাফীর মোট ১৫টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন, যেখানে তিনি যেন ৬৬৬ রান, উইকেট নেন ৮টি।

নিজের শেষ ১০টি ওয়ানডে ম্যাচের একটিতে মাশরাফী পুরো ১০ ওভার বল করেন এবং শেষ ১০টি ওয়ানডে ম্যাচে পান একটি উইকেট।

২০১৯ সালে মাশরাফীর বোলিং গড় ৮৩.২৫।

মাশরাফী বিন মোত্তর্জা বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বোলার, এখনো পর্যন্ত ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী মাশরাফী।

বাংলাদেশের অধিনায়ক হওয়ার পর তিনি নিয়মিত জাতীয় দলে খেলছেন।

কিন্তু একটা কথা প্রায়শই শোনা যায় যে মাশরাফী “নন-প্লেয়িং ক্যাপটেইন”।

২০১৯ বিশ্বকাপের সময়ে একটি টক-শোতে ভারতের সাবেক পেস বোলার অজিত আগারকার প্রশ্ন তোলেন মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা বাংলাদেশ দল থেকে নিজেকে সরাবেন কি না।

আগারকার বলেন, “বাংলাদেশ একাদশে রুবেলের সুযোগ পাওয়া উচিত। আমি জানি তাদের জন্য মাশরাফিকে বাদ দেওয়া কঠিন, কিন্তু আপনি যদি এই বিশ্বকাপে তার ফর্ম দেখেন, আমি মনে করি তিনি একাদশে সুযোগ পান না।”

আগারকার মূলত বলেন যে বাংলাদেশের ব্যাটিং নিয়ে এখন চিন্তা নেই, মূল সমস্যা এখন বাংলাদেশের বোলিং।

ক্যারিয়ারে নানা উত্থান-পতন কাটিয়ে মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা প্রায় ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে খেলে যাচ্ছেন।

পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে মাশরাফীর অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল ইনজুরি।

মাশরাফী কবে অবসর নেবেন এই প্রশ্ন মূলত এই বছরই ভক্ত ও ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মধ্যে ঘুরপাক খায়।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল দুই আসন থেকে নির্বাচন করেন ও জয় পান।

অবশেষে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কিছুদিন আগে ঘোষণা দেন যে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্রিকেট সিরিজই হতে যাচ্ছে অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফীর শেষ ওয়ানডে সিরিজ।

১৯শে ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের এই কথা বলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নাজমুল হাসান পাপন।

২০১৮ সালে অনেকে ধারণা করছিলেন ২০১৯ ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলার পর ক্রিকেটকে বিদায় জানাবেন মাশরাফী।

কিন্তু এরপর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ছাড়া মাঠে না নামলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের সময় সম্পর্কে কোনো কথাই বলেননি মাশরাফী।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট চলাকালীন নানা সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলা মূল কথা নয়, তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে যাবেন এবং নির্বাচকরা যদি তাকে ফিট মনে করে তাহলে তিনি জাতীয় দলে খেলা চালিয়ে যাবেন।

নিজের অবসর নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর দেননি মাশরাফী।

২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচ বল করে একটি উইকেট পান মাশরাফী

মি. নাজমুল হাসান পাপন বলেন, “এরপর দলে থাকতে চাইলে অন্য ক্রিকেটারদের মতো ফিটনেস প্রমাণ করে এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার পর নির্বাচকরা যথেষ্ট মনে করলে মাশরাফী জাতীয় দলে সুযোগ পাবেন।”

২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখে এক মাসের মধ্যে নতুন অধিনায়ক ঠিক করা হবে বলেও জানান নাজমুল হাসান পাপন।

সাকিব আল হাসানকে প্রথম পছন্দ হিসেবে রাখলেও নিষেধাজ্ঞার কারণে তার কথা আপাতত মাথায় আনছে না জানিয়েছেন বোর্ড প্রধান।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের পর আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি টি টোয়েন্টি সিরিজ ছাড়া টানা হারছে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই সিরিজে ৩ ও ৬ তারিখ আরো দুটো ওয়ানডে ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ।