ছবি: রাবেয়া সুলতানা রাব্বি

মোটর মেকানিক হিসেবে কেয়ার বাংলাদেশে কাজ করছেন রাব্বি। প্রথমে রাবেয়া সুলতানা রাব্বির ইচ্ছে ছিল না মোটর মেকানিক হওয়ার। দারিদ্রতার কষাঘাতেই আজ তিনি এ কাজে উপার্জনের পথ খুঁজে পেয়েছেন। সংসারে অনেক অভাব, বাবা-মায়ের কষ্ট অন্যদিকে বড় ভাইয়েরাও সংসারের খরচ না দেয়াই এই কাজে নামেন রাব্বি। 

অভাবের কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি রাবেয়া সুলতানা। ২০০৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল তার। ফরম ফিলআপের টাকা রাব্বির বাবা জোগাড় করতে পারেনি তাই এসএসসি পরীক্ষাও আর দেয়া হয়নি। পড়ালেখা থেকে ছিটকে পড়েন তিনি। অতঃপর দিনাজপুরের একটি এনজিওতে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেন রাব্বি। 

২০০৫ সালে কেয়ার বাংলাদেশ এনজিও থেকে একজন মাঠকর্মী রাব্বির বাড়িতে আসেন। তিনি জানান, গরীব নারীদেরকে তারা ব্লক, সেলাই ও ড্রাইভিংয়ের কাজ শেখাবে। ব্লক বা সেলাইয়ের কাজ শিখলে সংস্থাটি জিনিসপত্রগুলো ফ্রি দিবে। আর ড্রাইভিং শিখলে তারাই চাকরি দিয়ে দিবে। বেতন দশ হাজার টাকা।

এরপর রাব্বি ভাবলেন, দশ হাজার টাকা তো অনেক। এই টাকা দিয়ে তার সংসার অনেক ভালো চলবে। আর এটা তো একেবারেই অন্যরকম পেশা। যেখানে সে কখনো গাড়িতেই উঠেনি আর এখন নিজেই গাড়ি চালাবে। অতঃপর তিন মাস  প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেন রাব্বি। এরপর চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য তার ডাক পড়ল ঢাকায়।

যদিও ইন্টারভিউটা সেসময় ভালো হয়নি তার। কারণ তখনো রাস্তায় গাড়ি চালানোর মতো উপযুক্ত হননি রাব্বি। ইন্টারভিউ দেয়ার এক মাস পরই এপ্রিলেই তার বিয়ে হয়ে যায়। পরের মাসেই সেখান থেকে রাব্বিকে আবার ডাকা হয়। তবে বিবাহিত হওয়ার কারণে তার মা বাধা দেয়। সেইসঙ্গে তার শ্বশুর-শ্বাশুরি ও স্বামীরও অনুমতি নিতে হবে।

বাধ্য হয়ে রাব্বি স্বামীকে সবকিছু জানায় রাব্বি। তার স্বামী যেতে অনুমতি দেয়। রাব্বি তার শ্বশুর-শ্বাশুরির কাছ থেকেও অনুমতি নেয়। নয় মাস প্রশিক্ষণের পর ২০০৬ সালে মোটর মেকানিক হিসেবে কাজ শুরু করেন রাবেয়া সুলতানা রাব্বি। প্রশিক্ষণের আগে তাদেরকে জানানো হয় তারা টেকনিশিয়ানের কাজ বা ড্রাইভিং যে কোনোটাই শিখতে পারে। রাব্বি সিদ্ধান্ত নেয় সে টেকনিশিয়ানের কাজটা শিখবে। 

মোটর মেকানিক হিসেবে প্রথমে টাঙ্গাইলে তিন বছর কাজ করেন রাবেয়া সুলতানা  রাব্বি। মেয়েদের তো সমাজ সবসময়ই আলাদা ভাবে দেখে। মেয়ে এটা পারবে না, মেয়েদের পক্ষে এটা সম্ভব না এটা সবারই ভাবনা। মাঠ থেকে যে রাইডাররা কাজ করাতো প্রথমে তারা মনে মনে হয়ত একটু অনীহা প্রকাশ করতো। প্রকাশ্যে বলত না কারণ অফিসের নিয়ম আছে নারী পুরুষে ভেদাভেদ নেই।   

মোটর সাইকেল থেকে শুরু করে কার, জীপ সব ধরনের গাড়ির কাজ করতে পারেন রাবেয়া। গাড়ির ইলেকট্রিক ফল্ট আসলে খুব বিরক্ত লাগে কারণ অনেক মাথা খাটাতে হয়। গাড়ির অনেক ভারী যন্ত্রাংশ আছে, যেমন- গিয়ার বক্স যা একার পক্ষে সরানো সম্ভব না। সাসপেনশানের কাজে অন্যরা সাহায্য করে।  

মেকানিকের কাজের পাশাপাশি সংসারও সামলান রাবেয়া সুলতানা। রাব্বি বলেন, অফিসের কাজের শেষে বাসায় গেলে শক্তি আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়। সবকিছুর মাঝে আমি একজন মা, একজন স্ত্রী। অতিরিক্ত আয়ের জন্য তাই ওভার টাইমে কাজ করেন তিনি। রাব্বি জানান, ২০০৫সালে যখন কাজটি শুরু করে তখন তার খুব ভয় লাগত কখন চাকরি চলে যায় এই ভেবে। 

এখনো অবশ্য সে ভয়টা তার মনে রয়েছে। কারণ মায়ের সংসারও স্বামী, সন্তানের দেখাশুনা সবই তো তাকেই করতে হয়। রাব্বির স্বপ্ন তার ছেলেকে উপযুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। রাব্বি যে কষ্টটা করছে, তার সন্তান যেন কষ্টটা না করে। সাধ্যের সবটুকু দিয়ে রাব্বি তার ছেলেকে মানুষ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।