নিকারাগুয়ার আলোর মানুষের মহাপ্রস্থান

তিনি ছিলেন একাধারে একজন যাজক, একজন শক্তিমান কবি এবং একজন আপাদমস্তক বিপ্লবী। মাথায় থাকত কালো বেরেট টুপি, পরনে সাদা পাতলা জামা। এ ছিল তাঁর নিজস্ব স্টাইল। সদাহাস্য তাঁর এই সৌম্য স্নিগ্ধ চেহারার আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক বিপ্লবীর প্রতিচ্ছবি। তিনি কবি আর্নেস্তো কার্দেনাল, পুরো নাম আর্নেস্তো কার্দেনাল মার্টিনেজ। লাতিন আমেরিকা তথা নিকারাগুয়ার সাহিত্য এবং বিপ্লবের অন্যতম প্রাণপুরুষ। গেল রোববার মার্চ মাসের প্রথম দিনে ৯৫ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে গেলেন নিকারাগুয়ার এই আলোর মানুষ।

আর্নেস্তো কার্দেনালের জন্ম ১৯২৫ সালের ২০ জানুয়ারি, নিকারাগুয়ার গ্রানাডা শহরের এক বিত্তশালী পরিবারে। মাত্র সাত বছর বয়সে কবিতায় তার হাতেখড়ি হয়। ১৯৪৩ সালে মেক্সিকো যান, সেখানে সাহিত্য আর দর্শন নিয়ে লেখাপড়ার উদ্দেশে। এরপর আমেরিকার কলম্বিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর উত্তর আমেরিকার সাহিত্য নিয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। এই সময়গুলো লিখেন অজস্র কবিতা। প্রাথমিক জীবনের কবিতাগুলো ছিল রোমান্টিসিজম ঘরানার। ধীরে ধীরে এই ধারা থেকে বের হয়ে তিনি জীবন ও মানবতার পক্ষে কলম ধরেন। ১৯৩২ সাল থেকেই নিকারাগুয়ায় চলছিল একনায়ক এনাস্টাসিও সমোজার শাসন। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে তরুণ আর্নেস্তো কার্দেনালের লেখায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে মানবতার গান। প্রেম ও দ্রোহের যুগলবন্দি তার লেখাগুলো ক্রমেই সাধারণ মানুষের মুক্তির সোপান হিসেবে কাজ করতে থাকে। সমোজার শাসনব্যবস্থায় কবিতা প্রকাশও একসময় কঠিন হয়ে ওঠে। ফলে কার্দেনাল ছদ্মনামে নিকারাগুয়ার বাইরে থেকে কবিতা প্রকাশ করতে উদ্বুদ্ধ হন। বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালে তিনি যোগ দেন নিষিদ্ধ ঘোষিত বামপন্থি দল UNAP (National Union for Popular Action)-এ। সে বছর এপ্রিল মাসে UNAP এক অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়, যা ‘এপ্রিল আন্দোলন’ নামে পরিচিত। অন্য অনেকের মতো কার্দেনালকেও পালিয়ে যেতে হয়। আর এ সময়েই লেখা হয় তার সবচেয়ে আলোচিত ও বিখ্যাত কবিতা ‘তবৎড় ঐড়ঁৎ’। ১৯৭৯ সালে এনাস্টাসিও সমোজার পতনের পর সানডিনিস্টা সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন কার্দেনাল। এই দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। কমিউনিজমের প্রতি পূর্ণ আস্থা থাকলেও কার্দেনালের অন্তরে ছিল খ্রিষ্টের প্রতিও ভালোবাসা। ফলে ১৯৬৫ সালে ধর্মযাজকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কিন্তু তার কাজে খুশি হতে পারেননি ভ্যাটিকান সিটির পোপ। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন পোপ জন পল টু কার্দেনালকে ধর্মযাজকের পদ থেকে বহিস্কার করেন। দীর্ঘ তিন দশক পর, ২০১৯ সালে পোপ ফ্রান্সিস এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।

সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ২০০৫ সালে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি শান্তি পুরস্কারসহ লাতিন আমেরিকার প্রায় সব কয়টি বড় সাহিত্য পুরস্কার রয়েছে কার্দেনালের ঝুড়িতে। কবিতা ও গদ্য মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা ২০টিরও বেশি। চিরতরে ঘুমের দেশে পাড়ি জমানোর আগ পর্যন্ত প্রেম আর মানবতার গান গেয়ে যাওয়া এই আলোর মানুষ স্বপ্ন দেখতেন সাম্যের পৃথিবীর। সেই স্বপ্ন পূরণ না হলেও তার সৃষ্টি থেকে যাবে অনেক অনেক দিন। সবশেষে তার একটি কবিতার কয়েকটি লাইন উদ্ৃব্দতি করা যাক- ‘আমি নিষিদ্ধ সেই লিফলেটগুলো বিলি করে বেড়িয়েছি/ রাস্তার মাঝখানে সশস্ত্র সৈনিকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে/চিৎকার করে বলেছি বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।’