গত ১৯ জুন ২০২০-এ অনুষ্ঠিত বর্ণিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (ANTS) বাংলাদেশের এক দল ছাত্রের (অঘঞঝ) উদ্ভাবিত নকশা সর্বোচ্চ পুরষ্কার লাভ করে।

ANTS নিয়ে কিছু কথা :

ANTS দলটি ওআইসি পরিচালিত আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি(আইইউটি)-তে

প্রকৌশল বিষয়ক বিভিন্ন অনুষদ(যন্ত্রকৌশল,তড়িৎকৌশল এবং প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা) -এ স্নাতকে অধ্যয়নরত ১৪ জন দক্ষ ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত।

দলটির প্রতিটি সদস্যই অসম্ভব স্বপ্নবিলাসী এবং স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে । সেই স্বপ্নগুলোর মধ্যে অন্যতম স্বপ্নটি ছিল পেশাগত প্রকৌশলীদের নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্সটিটিউশন অব মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারস কর্তৃক আয়োজিত ও পরিচালিত আনম্যান্ড এয়ারক্রাফট সিস্টেম তথা ইউএএস চ্যালেঞ্জ বা মানবহীন বিমান ডিজাইন করা ও বানানোর চ্যালেঞ্জিং প্রতিযোগিতাটিতে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মত অংশগ্রহণ করা

আমাদের মাঝেমাঝেই জিজ্ঞাসা করা হয় আমাদের টিমের নাম ANTS কেন?:
উত্তরটি খুব সহজ -অহঃং বা পিঁপড়া প্রাণী হিসেবে যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন তারা একটি দল হিসেবে বৃহদাকার যে কোন কাজ করতে পারে । তারা সংগঠিত , তারা দলগত কাজকে মূল্যায়ন করতে জানে এবং তারা কখনো কোন কাজ সম্পাদনে পিছপা হয় না । যেহেতু আমাদের দেশ প্রযুক্তিগত ভাবে এখনও কিছুটা পিছিয়ে সেজন্য যেকোন ধরনের উন্নত যন্ত্রপাতির সংস্থান ও সংগ্রহ মোটেও সহজ নয় । তারপরও শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে আমাদের একটি লক্ষ্যই ছিল আমাদের মানববিহীন যানটিকে আকাশে অক্ষত অবস্থায় উড়তে দেখা এবং একমাত্র পিঁপড়ার মত নিরলসভাবে লেগে থাকলেই সে লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব ।

ইন্সটিটিউশন অফ মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার আনম্যানড এয়ার সিস্টেম (টঅঝ) চ্যালেঞ্জ ২০১৪ সালে এর যাত্রা শুর করা থেকেই এর মূল লক্ষ ছিলো পেশাদার ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করা এবং তরুন সমাজকে উদ্দীপ্ত করা, প্রতিযোগিতাটি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অনেক উৎসাহী দলদের আকৃষ্ট করছে।

২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত ইউ এ এস ইভেন্ট এর কিছু মুহূর্ত। করোনা পরিস্থিতিতে এ বছর ইভেন্টটি ভারচুয়ালি অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়।

অসামান্য অর্জন:
বর্তমান বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ইউএএস চ্যালেঞ্জের মূল প্রদর্শনী ইভেন্টটি বাতিল করা হয় যেটি হওয়ার কথা ছিল ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ার এ অবস্থিত BMFA এয়ারফিল্ডে।
মূল ইভেন্টটি বাতিল হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে জমাদানকৃত ডকুমেন্ট,ভিডিও,পোস্টার ও অন্যান্য দলিলাদি বিবেচনা করে বিভিন্ন প্রকৌশল ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক দক্ষতার জন্য সেরা দলদের জন্য ৬টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। বিজয়ী দলের নাম ১৯ জুন অনুষ্ঠিত অনলাইন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানের সূচনা করেন IMechE সভাপতি টেরি স্প্যাল ।
উক্ত অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো অংশ নেওয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির দল ANTS তিনটি পুরস্কার অর্জন করে নেয় ।
অর্জন সমূহ ও বিচারকবৃন্দের মন্তব্যঃ
1. Media & Engagement Award – বিচারক জোসেফ অ্যালান দলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন ‘’তারা প্রচার কার্যক্রমে ১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি অসাধারণ উদ্যোগ দেখিয়েছে। তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেজ, স্থানীয় ও জাতীয় স্তরে প্রতিবেদন তাদের অভিজ্ঞতা ও সাফল্য বিস্তর দর্শকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।“

2.Business Proposition Award -বোম্বার্ডিয়ার এয়ারস্পেসের বিচারক স্টিফেন ফিলিপস এই বছর দলগুলির উপস্থাপনায় সন্তুষ্ট ছিলেন। “তবে ড্রাগন ডেনের একটি স্পষ্ট বিজয়ী দল ছিল: টিম অ্যান্টস” তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন: “দলটি একটি ভালভাবে উপস্থাপিত ব্যবসায়িক প্রস্তাবনা সরবরাহ করেছে যাতে তারা তাদের টার্গেটের বাজার সম্পর্কে তাদের জ্ঞানটি প্রদর্শন করেছে। তাদের ইউএএস কীভাবে প্রয়োগ করা যায় তার বাস্তব উদাহরণ রয়েছে এতে। জরুরী প্রতিক্রিয়া এবং কৃষি শিল্পে একটি বাস্তবসম্মত বিক্রয় অনুমান এবং ব্যয় অভিক্ষেপের সাথে কিছু বিকল্প পরিকল্পনাও দেখানো হয়েছে। ”
3. Highest Placed New Entrant -অবশেষে, উল্লেখিত এবং অন্যান্য বিভাগগুলিতে পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে টিম অ্যান্টস ইউএএস চ্যালেঞ্জের নতুনদের অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে সর্বাধিক নাম্বারপ্রাপ্ত হয় এবং “হাইয়েস্ট প্লেসড নিউ এন্ট্রান্ট অ্যাওয়ার্ড” অর্জন করে নেয়।
এই বছর, ২০১৯ সালে জেতা বিশ্ববিদ্যালয় দলগুলির বাইরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিততে দেখা গিয়েছিলো, যেমন কুইন্স ইউনিভার্সিটি বেলফাস্টের দল, যারা সম্মানজনক, “সেরা ডিজাইন” পুরষ্কার অর্জন করে।
এদিকে, লন্ডনের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয় সুরক্ষার জন্য এই বছরের “সেফটি অ্যাওয়ার্ড” অর্জন করে । ইউনিভার্সিটি অফ টোয়েন্টির টিম এ৩টি, হ্যাডার্সফিল্ডের টিম হওক কে অল্প ব্যবধানে পরাজিত করে পেয়েছে ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড।
টিম এন্টস (ANTS)  মিডিয়া এবং জনসংযোগমূলক কার্যক্রম:
স্কুলকলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা এবং এন্টস (অঘঞঝ) এর প্রজেক্ট সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার লক্ষ্যে কারিগরি কার্যক্রমের সাথে সাথে নিরলসভাবে মিডিয়া এবং জনসংযোগমূলক কার্যক্রম করে এসেছে। সকল কার্যক্রম সোশ্যাল মিডিয়া এবং সরাসরিভাবে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্টেম আউটরিচ প্রোগ্রাম, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে নিউজ রিপোর্ট এবং ফেসবুকে লাইভ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য।
টিম এন্টস (ANTS) ঢাকা শহরের উল্লেখযোগ্য ৩২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্টেম আউটরিচ কার্যক্রমের পরিকল্পনা করেছিল; যার মধ্যে ১৫টি সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং করোনা পরিস্থিতির কারণে বাকীগুলো বাতিল করা হয়। আমাদের প্রজেক্ট কে ইতোমধ্যে দেশের অন্যতম সংবাদমাধ্যম চ্যানেল আই, বিডিনিউজ২৪ এ ফিচার করা হয়েছে।

যখন পুরো পৃথিবী লকডাউন এ আবদ্ধ টিম আ্যন্টস্ তাদের লক্ষ্য অর্জনে তখনও থেমে থাকেনি; অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম চকবোর্ড আয়োজিত ফেসবুক লাইভ এর মাধ্যমে এ সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে আগ্রহী মানুষকে ইউএএস চ্যালেঞ্জ এবং প্রজেক্টটি সম্পর্কে জানাতে
আমাদের যানটির কিছু ডিজাইনগত এবং উদ্ভাবনী বৈশিষ্ট্যঃ
আমাদের প্রজেক্ট ফ্রিডম-৭১(এফ-৭১) অনেকটা গতানুগতিক উড়োজাহাজের আদলে তৈরি । দুটি প্রপেলার সম্বলিত ডানা এবং লেজটি মূল কাঠামো থেকে কার্বন রড দিয়ে পৃথককৃত । সাধারণ ড্রোন বা কপটার থেকে ডানা বিশিষ্ট ডিজাইনটি অনেক জ্বালানী সাশ্রয়ী, শক্তিশালী কাঠামো, অধিক গতিসম্পন্ন ।
আমরা চেস্টা করেছি আমাদের দেশে সহজলভ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের প্রজেক্টটির কাঠামো নির্মাণ করা। আমরা নিজেদের সিএনসি মেশিন (একধরণের কম্পিউটার কন্ট্রোল্ড মেটারিয়াল কাটার যন্ত্র) এবং সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার বানিয়েছি।

আমাদের যানটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি কয়েকটি অংশে বিভক্ত এবং প্রয়োজনমত খোলা যায় আবার লাগানো যায় যা অনেকটা পাজল সল্ভ করার মত ।

জরুরী ত্রাণ সরবারহের জন্য দেশীয় পাট দিয়ে ডেলিভারী বা সরবারহ বাক্স বানিয়েছি । পাট ব্যবহার করার কারণ হলো – পাট আমাদের ঐতিহ্যগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্পদ। সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠনে এর বৃহদাকার ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই ।

বিমানকাঠামোর ডিজাইনের ক্ষেত্রে আমরা সর্বনি¤œ মেটেরিয়াল ব্যবহার করে শক্তিশালী করতে চেষ্টা করেছি যাতে আমরা অধিক ত্রাণ নিতে পারি ।
যেহেতু আমাদের প্লেনটি পরীক্ষাগতভাবে উড়ানোর জায়গার সীমাবদ্ধতা ছিল আমরা চেষ্টা করেছি উন্নত সফটওয়্যার এর মাধ্যমে রিয়েল লাইফ এনভাইরনমেন্ট তৈরী করে পরীক্ষা করা যাতে বাস্তবে উড়ানোর সময় প্লেনের কোন ক্ষতি না হয় এবং হলেও খুব কম।

আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যানটির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে নিখুঁতভাবে ত্রান সরবরাহ করা এবং এর জন্য নিজস্ব এলগরিদম বানিয়েছি।

টীম ANTS নকশাকৃত বিমানের ক্যাড মডেল

প্রান্তীয় অসহায় মানুষের সহায়তা এবং কোভিড -১৯ এর বিরদ্ধে লড়াই করার জন্য এফ -৭১ এর ভূমিকা:
করোনা ভাইরাস এর এই বিশ্বব্যাপী মহামারীর মধ্যে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হল সম্ভাব্য রোগীদের পরীক্ষা করা । বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে অবকাঠামোগত অপ্রতুলতার কারণে পরীক্ষাগুলি খুব নগণ্য হারে করা হচ্ছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে এই ভাইরাস শনাক্তকরণের জন্য সরকার অনুমোদিত মাত্র ৫৬ টি পরীক্ষাগার রয়েছে যার বেশিরভাগই রাজধানী এবং বড় শহরগুলিতে । কিন্তু এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র দুই লক্ষ সাতাশি হাজার সাতশটির মতন নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে । যদিও ল্যাবগুলির অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং চিকিৎসা কর্মীদের প্রশিক্ষণ স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্জন করা প্রায় অসম্ভব, তবুও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নিকটস্থ ল্যাবগুলিতে দ্রুত নমুনা সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করা বর্তমানে একটি জীবন রক্ষাকারী উদ্যোগ হতে পারে।

আমাদের ইউএ যে কোনো মাল্টি-রোটার বা কপ্টার ইউএর চেয়ে বেশি গতিতে উড়তে সক্ষম যা এই করোনাকালীন সময়ে দ্রুততার সাথে নমুনাগুলি সংগ্রহ করতে সক্ষম । আমাদের এই ইউএভি(UAV) ডিজাইন করা হয়েছে আইমেকি(IMechE) ইউএএস চ্যালেঞ্জ ২০২০ এর নিয়ম মেনে যা প্যাকেজ বা ত্রান ডেলিভারি দিতে সক্ষম . এছাড়াও একজন অপারেটরের সাহায্যে এটি দূরবর্তী কোনো অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহ করে অল্প সময়ের মাঝেই কাছের ল্যাবগুলিতে পৌঁছে দিতে পারবে । দীর্ঘসময় ফ্লাইটের জন্য এর ব্যাটারীর সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব । মানববিহীন এই বিমানটির প্যারাশুট সহায়ক প্যাকেজ ড্রপ প্রক্রিয়াটি টেস্টিং কিট এবং নমুনার সুরক্ষা নিশ্চিত করে । যে দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, সেখানে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নিজ ঘর থেকে বের হয়ে কয়েক মাইল পাড়ি দিয়ে অন্য এলাকায় যাওয়া যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ, যা আক্রান্তদের সংখ্যা কয়েকগুন বাড়িয়ে দিতে পারে । এমতাবস্থায় , আমাদের এই ফ্রিডম -৭১ এই করোনাযুদ্ধে হতে পারে এক লড়াকু সৈনিক। আমাদের দলটি সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে ছিল তা হল দেশের মানববিহীন বিমান বিষয়ক ফিল্ডে দক্ষ ও অভিজ্ঞ মানুষ এর অভাব যার জন্য আমাদের বিভিন্ন সময়ে মুখোমুখি হওয়া ডিজাইনগত, প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান করতে বেগ পেতে হয়েছে । বিমানটি তৈরী করার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্রপাতি খুঁজে পাওয়াও ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং।
শেষ পর্যন্ত শিক্ষকদের দূরদর্শিতায় এবং দলের প্রত্যেকের অসামান্য উৎসর্গের ফলেই টিম এন্টস (ANTS) এর আজকের এ বিজয় ।