কারো সততার গল্প আমরা যখন শুনি অবাক হই, তার প্রতি শ্রদ্ধায় আনত হই। সে মানুষের সামনে একটা উদাহরণ হয়ে যায়। বাস্তবে সেটা হবার কথা নয়। একজন মানুষ সৎ হবে, পরিশ্রমী হবে, কলুষমুক্ত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু পুরোটা সমাজ এখন এতটাই কলুষিত যে সৎ হওয়া একটা মহৎ কাজ হিসেবে পরগণিত।
ঘুষ, চুরি, টেন্ডারবাজি, ছিনিয়ে নেয়া, ভাগ-বাটোয়ারার খবর প্রতিদিনই পাই। কোনো ভালো খবর, উদ্দীপনা পাবার মতো খবর কানে আসে না। এসবের মধ্যেই দীপক চন্দ্র বর্মন নামের একটি ছেলের কথা শুনলাম। সে একটি আবেদন করেছে। তার আবেদন আমাকে আবেগাপ্লুত করেছে। আমি মোহিত হয়েছি। সে আবেদন করেছে মাসিক বৃত্তি বাতিলের। মানুষ পেতে চায় এইতো সারাজীবন জেনে এসেছি। ছাড়তে চায় জানা ছিলো না। মানুষ বৃত্তি পাবার জন্য আবেদন করে। প্রয়োজন না থাকলেও করে। পাওয়া যখন যাচ্ছে নিয়ে নেই; ভাবখানা এমন। কোটি কোটি টাকা থাকার পরও সুযোগ থাকলে পাঁচ টাকাও পকেটস্থ করে। পরিবারের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন তহবিলে হাত পাতে। অক্লেশে মিথ্যে বলে। সাজিয়ে গুছিয়ে জানায় তাদের কত অর্থকষ্ট। টাকা না পেলে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। তারা নেয় বলেই যাদের প্রকৃত দরকার তারা পায় না। শুধু চিকিৎসা নয়, যেখানেই টাকার গন্ধ আছে সেখানেই মিথ্যাচার আছে।
বৃত্তি পাওয়ার জন্য আবেদন অনেক দেখেছি। বৃত্তি বাতিলের আবেদন এই প্রথম দেখলাম। বাকি জীবনে আর কখনও দেখব কীনা জানি না!
দীপক চন্দ্র বর্মন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র। নিশ্চিত সে ভালো ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসির মতো বিভাগে কোনো খারাপ ছাত্র চান্স পায় না। তার বাবা একজন ইটভাটার শ্রমিক। পিতার সামান্য আয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার খরচ চালানো তার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছিল। এই অবস্থায় ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ তার অনুকূলে মাসিক ৩৫০০ টাকা বৃত্তি প্রদান করে। এই বৃত্তি নিয়ে সে ২য় বর্ষে উন্নীত হয়। আর ২য় বর্ষে উন্নীত হবার পর সে ১৩ জানুয়ারি ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ বরাবরে বৃত্তি বাতিলের আবেদন করে। আবেদনে সে লেখে, ‘নমস্কার, আমি দীপক চন্দ্র বর্মন। আমি বর্তমানে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টে ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। আমি বিগত এক বছর ধরে মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে মাসিক ৩৫০০ টাকা করে নিয়মিত বৃত্তি পেয়ে আসছি। আমার বাবা একজন ইটভাটার শ্রমিক। তার সামান্য আয়ে ঢাকায় আমার লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ত। এমতাবস্থায় আপনার ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া বৃত্তি আমার লেখাপড়ার পথকে সুগম করেছে। আমি উক্ত বৃত্তি না পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বছরেই আমার ছন্দময় শিক্ষা জীবন হুমকির মুখে পড়ত। বর্তমানে আমি ঢাকা শহরে নিজের খরচ নিজে নির্বাহ করার মতো সামর্থ্য অর্জন করতে পেরিছে। আমি দুই তিনটা টিউশনি শুরু করেছি। তাই আমি মনে করি, এখন মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে বৃত্তি না পেলেও আমি আমার লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যেতে পারব। তাই আমার বৃত্তি বাতিল করে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
পরিশেষ আমার জীবন গঠনে অবদান রাখার জন্য মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিশেষ করে ফাউন্ডেশনটির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান চন্দ্রনাথ স্যারের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমার মতো অসহায় ও দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের যে পথচলা তার উত্তরোত্তর সাফল্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। আমি আশাবাদী আমিও একদিন মানুষের সাহায্যার্থে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারব। ধন্যবাদ।’
মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এ চিঠি পাবার পর তার বৃত্তি বাতিল করেছে কিনা আমার জানা নেই। আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবছি দরিদ্র দীপকের সততা আর মহৎ হৃদয়ের কথা। দীপকের অর্থ নেই, কিন্তু হৃদয় আছে। যা হাজার কোটি টাকার মালিকের নেই। দীপক চন্দ্র বর্মনকে আমি চিনি না। তার এই আবেদনটি ফেসবুকের পর্দায় ভাসছে। দীপক পোস্ট করেননি। পোস্ট করেছেন কিছু মানুষ যারা এ খবরে আমার মতোই অভিভূত হয়েছেন ।
সাহসী আত্মবিশ্বাসী দীপকের চেহারা আমি এখনো দেখিনি। তবে দেখতে চাই ২০২০ সালের এই হিরোকে।
লোভের আগ্রাসনে জর্জরিত আমরা। আমরা যতো পাই, ততো চাই। ক্ষুধা মেটে না। খাবার দেখলে হামলে পড়ি। পেটে ক্ষুদা নেই, চোখের ক্ষুধা মেটে না। প্লেট উপচে খাবার নিই। নষ্ট করি। অন্যকে বঞ্চিত করি। অকারণে অপ্রয়োজনে অক্লেশে চুরি করি। একবারও ভাবিনা, এই চুরি করার আদৌ কি প্রয়োজন আছে? এই চুরির টাকায় কি কোনো মঙ্গল হবে? কোনো কল্যাণকর কাজে লাগবে? চুরি আর কেলেঙ্কারিতে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছেন আমাদের রথি মহারথিরা। এক একটা প্রজেক্টের নামে হরি লুট হয়। এদেশের টাকা লুটে নিয়ে ইউরোপ আমেরিকা মালয়েশিয়া দুবাইতে সম্পদের পাহাড় গড়েছে অসংখ্য লোক। সুইচ ব্যাংকে চলে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়, ভল্টের মূল্যবান জিনিস চুরি হয়, চুরির কারণে ব্যাংক পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। লাখ লাখ আমানতকারী পথে বসে, লিজিং কোম্পানিগুলোর অবসান হয়। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা পথে বসে যায়। দু’বছর বাড়তি চাকরি, মাস গেলে ভাতার জন্য প্রতিদিন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তৈরি হয়। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় ভরে গেছে দেশ। শহিদের ছেলে মেয়ে পোষ্যদের জন্য নানান ব্যবস্থা হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু শহিদ বুদ্ধিজীবীর অনেকের নাম এখনো শহিদ তালিকাভুক্ত হয়নি বলে শুনেছি।
আজ আমার লেখার বিষয় দীপক চন্দ্র বর্মন। দীপক টিউশনি করে চলবে তবু বৃত্তি নেবে না। এই বৃত্তিটা পেলে হয়ত তার টিউশনি করতে হতো না। সে পড়াশুনায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করতে পারত। তার রেজাল্ট ভালো হতো। সে ভালো ফলাফল করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যেতে পারত। কেউ তাকে দোষারোপও করত না। কিন্তু সে তা করেনি। টিউশনি পাওয়ামাত্র সে বৃত্তি বাতিলের আবেদন করেছে। যাতে তার চেয়েও গরীর কোনো শিক্ষার্থী এই বৃত্তিটা পেতে পারে।
আমাদের সমাজের অনেকের চোখে দীপক বোকা। কেউ কেউ বলবে ছেলেটা গাধা। কেউ বলবে প্রচারের কৌশল। সে যাইই হোক, আমি দেখেছি তার সাহস আর আত্মবিশ্বাস। দীপকের মতো আমিও আশাবাদি একদিন সে মানুষের সাহায্যার্থে নিজেকে নিবেদন করবে।
একজন ইটভাটার খেটে খাওয়া শ্রমিকের সন্তান দীপক। শ্রমিক মজুররাই দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরায়। আর তারাই সমাজে সবচেয়ে উপেক্ষিত। দীপকের দিল দারিদ্ররেখা অতিক্রম করে আকাশ ছুঁয়েছে। এই দিল, এই বুক ও পেলো কোথায়! বাংলাদেশের মতো দরজা যে বুক!
স্যালুট দীপক চন্দ্র বর্মন!