হরলাল রায় সাগর, সিনিয়র রিপোর্টার: বেপরোয়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত সেই বিমানবালা সুন্দরী সৈয়দা মাসুমা মুফতিকে নিয়ে তোলপাড় চলছে। তার অন্ধকার জীবনের খোঁজ-খবর নিতে শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু (বিমানবালা) ছিলেন মাসুমা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে (বিজি ০০১) যাওয়ার কথা ছিল তার। মদ্যপ অবস্থায় দায়িত্ব পালনের যাওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রাউন্ডেড (দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি) করা হয়।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, মাসুমা মুফতির বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসার দিকে তাদের কড়া নজর রয়েছে। মাসুমার চলাফেরা ও তার অন্ধকার জগতের খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। একই এলাকায় থাকেন মাসুমার বস নুরুজ্জামান রঞ্জু। ঢাকায় থাকাকালীন মাসুমা মুফতি কাদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, কাদের সঙ্গে রাতে আড্ডা দেন, সেই খবরও পেতে শুরু করেছেন তারা। তার বাসায় প্রায়ই মনোরঞ্জনের আসর বসে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

তিনি জানান, সুন্দর চেহারা এবং আকর্ষণীয় ফিগারের কারণে মাসুমাকে দিয়ে সব সময় বিজনেস ক্লাসে ডিউটি করানো হতো। সেই সুযোগে তিনি দেশের ধনাঢ্য ও শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। এদের মধ্যে কার কার সঙ্গে তিনি অভিজাত এলাকায় রাতের পার্টিতে যোগ দেন, কার আস্তানায় ফ’র্ত করেন, বিদেশে কোথায় কার সঙ্গে একান্তে সময় কাটান এবং অবৈধভাবে কি কি বিদেশী মালামাল, স্বর্ণ সরবরাহ করেন তারও খোঁজ নেয়া হচ্ছে। পাশপাশি প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটের আগের রাতে এ ধরনের কোনো পার্টিতে অংশগ্রহণ করেছেন কিনা তার খোঁজ নেয়া হচ্ছে। কোথায় কী ধরনের মাদক গ্রহণ করেছেন তারও অনুসন্ধান চলছে। তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলেও ওই সূত্র জানায়।
সূত্রগুলো জানায়, সৈয়দা মাসুমা মুফতি দীর্ঘদিন ধরেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ফ্লাইট স্টুয়ার্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মহিলা কলেজে থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর ২০০১ সালের মে মাসে বিমানে যোগ দেন। ব্যক্তিজীবনে বিবাহিত মাসুমার এক মেয়ে রয়েছে। তবে স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই। মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকছেন তিনি। আর বিমানবালা হওয়ার সুবাদে অঢেল অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন তিনি।

নিজের মতোই পশ্চিমাধাঁচের জীবনযাপনে অভ্যস্ত মাসুমা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের একাধিক কর্মী জানান, মাসুমা মুফতি নিয়মিতই মাদকসেবন করতেন। মাদকসেবনের বিষয়টি সহকর্মীদের কাছে ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট। বিষয়টি ঊর্ধতনদের না জানিয়ে এতোদিন চেপে রাখতেন প্রভাবশালী কর্মকর্তা নুরুজ্জামান রঞ্জু। তার সঙ্গে মাসুমার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তবে মাসুমার হাত অনেক লম্বা বলে জানা গেছে। আর এজন্য পার পেয়ে যেতে পারেন সব অভিযোগ থেকে। কারণ একটি প্রভাবশালী মহল তাকে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিমান সূত্রে জানা গেছে, ২১ সেপ্টেম্বর কোন পরিস্থিতিতে মাসুমা মুফতি মদ্যপ ছিলেন এমন প্রশ্নের জবাবে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারছে না বিমান কর্মকর্তারা। এ প্রেক্ষাপটে গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ফিরতি ফ্লাইটেও বিমানের যেসব স্টাফ ডিডটি করবেন তাদের সবার ডোপ টেস্ট করার পরামর্শ দেয়া হয়। সেটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে লন্ড যান। এর আগে সকালে নিয়মানুযায়ী বিমানের ব্রিফিং রুমে র‌্যান্ডম ডোপ টেস্ট করার সময় ১৮জন কেবিন ক্রুর মধ্যে সবারটা নেগেটিভ হলেও শুধু মাসুমা মুফতির শরীরেই পজেটিভ সাইন ধরা পড়ে। অর্থাৎ তিনি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাদক সেবন করেছেন তা প্রমাণিত হয়। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাকে অফলোড করার। বিষয়টি তার বিভাগীয় প্রধান ওই ফ্লাইটের চিফ পার্সার কাস্টমার সার্ভিসের ডিজিএম নুরুজ্জামান রঞ্জুকে জানানো হলে তিনি চাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। আরেক সহযোগী ক্যাপ্টেন ফারহাত জামিল কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে তিনি ওই ফ্লাইটে পাইলট ইন চিফ হিসেবে লন্ড যান। তবে মাসুমাকে আর প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে যেতে দেয়া হয়নি। কিন্তু একদিন পরই আবারো মাসুমাকে সিঙ্গাপুর ফ্লাইটে ডিউটি দেয়া হয়। গোয়েন্দারা এ সংবাদ পেয়ে বিস্মিত হন। এত বড় ঘটনার পর কার সহযোগিতায় তাকে পরদিন আবার ড্রিমলাইনারে ডিউটি দিয়ে সিঙ্গাপুরে ফ্লাইট দেয়া হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে বিমানের সদ্য যোগদান করা গ্রাহক সেবা পরিচালক মমিনুল ইসলাম বলেন, সব খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। অনিয়মে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। ২৩ সেপ্টেম্বর মাসুাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি (গ্রাউন্ডেড) দেয় বিমান কর্তৃপক্ষ। মাসুমার মাদকসেবনের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন রঞ্জুও। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ২৪ সেপ্টেম্বর তাকেও গ্রাউন্ডেড করা হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লন্ডন থেকে ফিরিয়ে আনতে যাওয়া ফ্লাইটের ককপিটে বসার পর ফারহাত জামিলকে নামিয়ে আনা হয়। বিমান বলছে, তাকে ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণে অফলোড করা হয়েছে। মাসুমার মাদকসেবনের ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে জামিলের বিরুদ্ধে। জামিল প্রকাশ্য মাসুমাকে ‘ভালো মেয়ে’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এসব ঘটনা গোয়েন্দাদেও পাশপাশি বিমান কর্তৃপক্ষ তদন্ত করছে। এজন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে কমিটি সহকর্মীদের বাঁচাতে প্রভাবিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।