ছবির চিত্রনাট্য এত চমৎকারভাবে সাজানো যে ছবি দেখতে দেখতে পুরো ঘটনার সাথে আপনি জড়িয়ে যাবেন
পরিবর্তন স্বাভাবিক। যুগের সাথে অনেক কিছুই বদলেছে। মানুষ পুরোনোকে ফেলে দিয়ে নতুনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু পুরোনো রয়ে গেছে ঐতিহ্য হয়ে। ঐতিহ্যের চেয়েও বলা ভালো অস্তিত্ব হয়ে। যেটাকে ফেলে দিলে অস্তিত্ব সংকট তৈরি হয়।
তাই এরকম কিছু সময় আসে যখন মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তারা পরিবর্তনের সাথে যাবে নাকি ঐতিহ্যের সাথে থাকবে? বাংলার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব, শারদীয় দূর্গোৎসবের আগমনী শুরু হয় মহালয়ার মাধ্যমে। হিন্দু অধ্যুষিত কলকাতায় ঘটা করে পালিত হয় শারদীয় দূর্গোৎসব।
আরও পড়ুন : বিজেপি ও বলিউড
একটা সময় যখন ঘরে ঘরে ফেসবুকতো দূরে থাক টেলিভিশনই ছিল না, তখনো কিন্তু পূজোর আয়োজনের কোনও কমতি ছিলনা। ঘরে ঘরে টিভি ছিল না তো কি হয়েছে, ট্রানজিস্টারতো ছিল। ছিল কলকাতার আকাশবানী। আর মহালয়ার ভোরে সেই আকাশবানীতেই চণ্ডীপাঠ করতেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। বাঙালির ঘরে ঘরে তিনি পৌঁছে গেছেন তাঁর কণ্ঠ দিয়ে। হয়েছেন রেডিও জগতের সুপারস্টার।
সেই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠকে পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৭৬ সালে। এর পক্ষে যেসব আমলারা ছিলেন তাদের যুক্তি ছিল, অনেকতো হলো বীরেন্দ্র কৃষ্ণের কণ্ঠ, এবার নতুন কণ্ঠ আসুক।
কিন্তু আকাশবানী রেডিওর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছাড়া বাঙালি কল্পনাই করতে পারে না। আর পারবেই বা কীভাবে? সেই ১৯৩১ সাল থেকে চলছে। প্রথমে সরাসরি সম্প্রচার করা হতো স্টুডিও থেকে। পরবর্তীতে রেকর্ড করা অনুষ্ঠান প্রতি বছর পুন:প্রচার করা হয়।
আরও পড়ুন : দেবী রিভিউ : মনে রেখে দেবো!
ভারতের রেডিও ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলা রেডিও অনুষ্ঠান এটি, যার সময় মাত্র দেড় ঘণ্টা। এই আয়োজনের মূল দুই প্রাণ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রএবং পঙ্কজ মল্লিক। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ, আর পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গীতায়োজনে শিল্পীদের পরিবেশনায় অনুষ্ঠানটি বাঙালির হৃদয়ে পুজোর আগমনী বার্তা নিয়ে আসে।
১৯৭৬ সালে ভারতজুড়ে চলছে জরুরি অবস্থা। অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে ঠিক করা হলো চণ্ডীপাঠের আয়োজন একদম নতুন করে করতে হবে, নতুন কণ্ঠ, নতুন শিল্পী, নতুন কম্পোজার, সব নতুন। সে অনুযায়ী শুরু হলো কাজ। কম্পোজিশনের দায়িত্ব পেলেন হেমন্ত মুখার্জি। কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জায়গা কে নেবে? তাঁর কণ্ঠের যে আবেদন সেটা আর কার কাছে পাওয়া যাবে? ঠিক হলো মহানায়ক উত্তম কুমার চণ্ডীপাঠ করবেন।
শুরু থেকেই উত্তম কুমারের মনে দ্বিধা ছিল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পাঠের যে মুগ্ধতা সেটা তিনি ছুঁতে পারবেন তো? অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে কিছুই জানানো হয়নি। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের আগে উত্তম কুমার গিয়েছিলেন তাঁর সাথে দেখা করতে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র খুব সহজভাবেই নিয়েছিলেন ব্যপারটা। পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁর কোন আক্ষেপ ছিল না।
আরও পড়ুন : গ্রিন বুক: মানবিক অনুভূতি ও জীবনবোধের গল্প
‘মহিষাসুরমর্দিনী’ থেকে বদলে অনুষ্ঠানের নাম রাখা হলো ‘দুর্গা দুর্গতিহারিনী’। চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়লো, রিহার্সাল শেষে অনুষ্ঠান রেকর্ড হলো। ১৯৭৬ সালের মহালয়ায় চণ্ডীপাঠ করলেন উত্তম কুমার।
ফলাফলটা কি হলো? মেনে নিলো শ্রোতারা নাকি নতুনকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেই পুরোনোকেই আঁকড়ে ধরে রইলো?
এই ঘটনাবলীর উপজীব্য করেই তৈরি হয়েছে ‘মহালয়া’ চলচ্চিত্রটি যেখানে উত্তম কুমারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন যীশু সেনগুপ্ত এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রে শুভাশীষ মুখার্জি। ছবিটি পরিচালনা করেছেন সেীমিক সেন।
ছবির চিত্রনাট্য এত চমৎকারভাবে সাজানো যে ছবি দেখতে দেখতে পুরো ঘটনার সাথে আপনি জড়িয়ে যাবেন। শুভাশীষ মুখার্জি তাঁর মাপা অভিনয় দিয়ে মুগ্ধ করেছেন। তবে যীশু সেনগুপ্তকে ঠিক উত্তম কুমার মনে হয়নি। আসলে বাঙালির মানসপটে যে উত্তম আছেন সেই উত্তম হয়ে ওঠা তো খুব একটা সহজ কাজ নয়, তবে যীশু ভালো করেছেন, বিশেষ করে উত্তম কুমারের বেশ কিছু শরীরী ভঙ্গি তিনি ধরতে পেরেছেন। সব মিলিয়ে যে ঘটনাকে উপজীব্য করে ছবির গল্প সেটা এতটাই নাটকীয় এবং স্পর্শকাতর যে এই ঘটনা নিয়ে এতদিন কেন এরকম ছবি হয়নি সেটাই আশ্চর্য লাগবে!