মাহফুজ আনাম জেমস, জেমস

আজ ২ অক্টোবর, জেমসের জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা গুরু…

১৯৯৩ সালে ফিলিংস ব্যান্ডের ফটোশুটে মাহফুজ আনাম জেমস ও অন্যান্যরা ছবি সৌজন্যে: ইমতিয়াজ আলম বেগসময়টা ১৯৯৫ কিংবা ৯৬। এখনকার মতো এত রকমের বিনোদন না থাকলেও বিনোদিত হতে সমস্যা হতো না। বিটিভিই ছিল প্রধান বিনোদন মাধ্যম। ততদিনে মনের খোরাক মেটানোর এক বিশাল জগতে প্রবেশ করে ফেলেছি। যদিও তখন আমার জন্য তা ছিল নিষিদ্ধ। “আউট বই” – পাঠ্যপুস্তকের বাইরের কোনো সাহিত্যের বইকে এ নামেই ডাকতেন অভিভাবকরা।

এরই মধ্যে পরিচয় তাঁর সঙ্গে। হঠাৎ করে পাওয়া একটি অডিও ক্যাসেট নেড়েচেড়ে দেখতে থাকি। ক্যাসেটটার নাম “নগর বাউল”।

সে বছরই মুক্তি পেয়েছিল অ্যালবামটি। ক্যাসেটের কভারে চারজন মানুষের ছবি। মেঝেতে বসা মানুষটিকে সহজেই বাকিদের থেকে আলাদা করে চোখে পড়ে। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, কভারের ছবিতে মেঝেতে বসা মানুষটি কালো টি-শার্টের ওপর লাল চেকশার্ট পরেছিলেন। বুনো কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল। তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিতে “ডোন্ট কেয়ার” ভাবটি স্পষ্ট।

বাবার টু-ইন-ওয়ানে ক্যাসেটটি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল গীতিকার দেহলভীর লেখা গান, 

নাগ নাগিনীর খেলা, স্বর্পরাজ্যের খেলা,

বিষধর তোলে ফেনা, ছোবলে বিষের জ্বালা….

আমি নড়েচড়ে বসলাম। আমার সামনে নতুন আরেকটি দিগন্ত উন্মোচিত হলো। গানের, বিশেষ করে ফিলিংস ব্যান্ডের গানের সঙ্গে পরিচয় হলো এই অ্যালবামের মাধ্যমে।

ক্যাসেটের ফিতা টেনে প্রথম থেকে দিলাম, আবার শুনলাম। কি কথা, কি সুর, কি কণ্ঠ! জাদু করে ফেলল। সেই শুরু! ফিতা ক্যাসেটের যুগের সব ফিলিংস, নগর বাউল ও জেমসের একক গানের ক্যাসেট আমার সংগ্রহে ছিল। মা বকতেন, গান বন্ধ কর। বাবার নির্দেশ আরো উদ্ভট, ওই সব গান টু-ইন-ওয়ানে বাজাবি না। এটা নষ্ট হবে। আমি খবর শুনতে পারব না।

কৈশোরে যে গানের নেশা মাথায় ঢুকিয়ে দিল ফিলিংস, তা থেকে বেরোতে পারলাম না। কিন্তু এভাবে গানের নেশায় পড়ার কারণ কী? কারণ, ওই একজনই। নগর বাউল অ্যালবামের কভারে লাল চেকশার্ট পরে মেঝেতে বসে থাকা সেই মানুষটি। কারণ, ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। 

আমার বেড়ে ওঠা নব্বইয়ের ঢাকাতে। নব্বইয়ের দশক ছিল মূলত কনসার্ট ও ব্যান্ড কালচারের জন্য স্বর্ণযুগ। প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও কনসার্ট লেগেই থাকত। জেমসের পিছু নিতে গিয়েই চেনা হয় ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম, ঢাকা কলেজ, টিএসসি, ধানমণ্ডি উইমেন্স কমপ্লেক্স, কলাবাগান মাঠ, আবাহনী মাঠ। জেমসের কনসার্টের লোভে রাজধানী তাড়িয়ে বেড়ানো সেই দুরন্ত কৈশোর।

শহুরে সন্ধ্যার আড্ডা থেকে শুরু করে প্রান্তিক গ্রামীণ হাটেও বাজতে থাকে তার গান।

সহজ ভাষায় গানের গল্পগুলো শুনিয়েছেন তিনি আমাদের। কখনো ফাঁসির আসামীর কনডেম সেলে মৃত্যুর দিন গোনার গল্প আবার কখনো একপাশে জমিয়ে রাখা অশ্রু, দীর্ঘশ্বাস আর স্মৃতির হাত থেকে পালিয়ে থাকার গল্প। 

জেমসের ভরাট গলা শুনেই প্রেমিকেরা তাদের সুন্দরীতমাকে আকাশ বিলিয়ে দেয়, ভার্সিটির হলগুলোর ছাদে কেউবা চিৎকার করে জানান দেয়, “তারায় তারায় রটিয়ে দেবো তুমি আমার”। কিশোর থেকে মধ্যবয়সী সকলকেই কাঁদায় জেমসের দরাজ কন্ঠে ভরা, ”বাবা কতদিন দেখিনা তোমায়”। হারিয়ে যাওয়া মায়ের প্রতি ভালোবাসায় রাতের তারাকে প্রশ্ন করে কেমন আছে তার মা! 

১৯৯৩ সালে বাম্বা আয়োজিত কনসার্টে মাহফুজ আনাম জেমস ও সুমন ছবি সৌজন্যে: ইমতিয়াজ আলম বেগ

লম্বা কোঁকড়ানো চুল নিয়ে গিটার হাতে যেই মানুষটা মঞ্চে উঠেন তখন বুঝতে বাকি থাকেনা বাংলাদেশে পুরোনো থেকে উঠতি যত ব্যান্ড আছে এদের মাঝে জেমস যেন এখনো এক অনন্য উচ্চতায়। জেমস মানেই যেন অন্য গ্রহের কেউ একজন। নগর বাউলের গান আমাদের হাসায়, কাঁদায়, নতুন উদ্যমে বাঁচতে শেখায়। তাই তো এখনো জেমসের জন্মদিনে ঢাকা শহর ছেয়ে যায় গুরুর ছবি আর ব্যানারে।

বলিউডে গেলেন জেমস। সেখানেও প্লেব্যাক করে কাঁপিয়ে দিলেন। আন্তর্জাতিক রকস্টারে পরিণত হলেন। কিন্তু তাঁর উদাসী আচরণ, খেয়ালিপনা, আত্মমগ্নতা ঠিক আগের মতই আছে। পত্রিকা, টিভি কোথাও তিনি সরব নন। গান ছাড়া তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

টিভিতে এখন লাইভ কনসার্ট হয়। সেখানেও জেমস দেখিয়েছেন তাঁর নিজস্বতা। কখনো অপেরা গায়িকা, কখনো তানপুরা বা কখনো হারমোনিয়ামের সঙ্গে নিজের গানগুলো নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন। কোথায় তাঁর উপস্থিতি বা প্রভাব এতটুকু ম্লান হয়নি।

একজন রকস্টার থেকে তরুণ প্রজন্মের কাছে “গুরু”-তে পরিণত হয়েছেন তিনি। তাঁর পাগল ভক্তরা তাঁকে ভালোবেসে ডাকেন,‘গুরু জেমস’। জেমসের এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা আজকের মিডিয়া বা ব্র্যান্ড প্রমোশনের মতো আরোপিত ছিল না। তাঁর সঙ্গে ভক্তদের যোগাযোগ ছিল সরাসরি, যার মাধ্যম ছিল শুধু গান।

আজ ২ অক্টোবর, জেমসের জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা গুরু। তাঁর গান দিয়েই ভালোবাসা জানাচ্ছি তারুণ্যের এই রকদেবতার প্রতি –

বাগান উজাড় করে,

নিঃসঙ্গ একটি ফুল…

আজো জেগো আছে একা,

শুধু তোমার জন্য……