অনলাইন ডেস্ক :‘ভাঙা মন নিয়ে তুমি আর কেঁদো না, সব চাওয়া পৃথিবীতে পাওয়া হয় না’ গানের চরণগুলো মেনে নিয়ে অনেক দম্পতিই আলাদা হয়ে যাচ্ছেন। যেন ভাঙা কাচের মতোই ভেঙে যাচ্ছে একের পর এক সংসার। এর প্রভাব পড়ছে তাদের অবুঝ ছোট ছোট সন্তানসহ কাছের মানুষগুলোর ওপর। আর সেটি যে কতটা নেতিবাচক, তা শিশু সালিম সাদমান ধ্রুব ও সাদিক সাদমান লুব্ধের আবেগ, প্রশ্ন, কথাবার্তা থেকেই বোঝা যায়।
হাইকোর্টের এজলাসে দাঁড়িয়ে ১২ বছরের ধ্রুব বাবা-মায়ের দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন ছুড়েছে ‘ওরা আলাদা হলো কেন? আমরা দুজনের কাছেই থাকতে চাই। ওরা একসঙ্গে না হলে আমরা কারো কাছেই যাব না। আমরা দুজনকেই ভালোবাসি। একসঙ্গে না হলে বাবা-মা হয়েছে কেন? আব্বু তুমি আম্মুর কাছে সরি বলো, আম্মু তুমি আব্বুর কাছে সরি বলো। দুজন একসঙ্গে বাসায় চলো।’

বাবা-মাকে জড়িয়ে দুই শিশুর কান্না, তাদের আকুতি, আবেগ দেখে উপস্থিত বিচারপতি, আইনজীবীসহ সবার চোখেই পানি এসে যায়। দুই সন্তানকে নিজ হেফাজতে নেওয়ার দাবিতে মায়ের করা এক রিট আবেদনের ওপর শুনানিকালে গতকাল বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
বিচারপতিরা তখন বলেন ‘সাবজেক্ট মেটার বাপ-মা, কিন্তু দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সন্তান দুটি। আমাদের পেশাগত জীবনে এমনটি দেখিনি। আজ পেশার বাইরে গিয়েও তাদের বক্তব্য শুনতে হচ্ছে। তোমরা (ওই দম্পতির দুই সন্তান) আরও জোরে বলো, তোমাদের বাপ-মায়ের শিক্ষা হোক।’ আইনজীবীরা তখন দাঁড়িয়ে ওই দম্পতির উদ্দেশে বলেন আমরা ভাই-বোন হিসেবে বলছি, তোমরা এক হয়ে যাও। শুধু বাচ্চা দুটির মুখের দিকে চেয়ে আজই এক হয়ে যাও।
যে দম্পতিকে ঘিরে এই ঘটনা তাদের একজন কামরুন্নাহার মল্লিকা রাজশাহীর মেয়ে এবং কলেজ অব অলটারনেটিভ ডেভেলপমেন্টের (কোডা) শিক্ষিকা। ছেলে দুটির বাবা ওয়ান ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা মেহেদী হাসান মাগুরার মহম্মদপুর থানার বাসিন্দা। মল্লিকা ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ও মেহেদী ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই সময়ই তাদের মধ্যে প্রেম হয়। পরে দুপক্ষের সম্মতিতে ২০০২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন তারা। সুখি দাম্পত্য জীবনে তাদের ঘর আলোকিত করে আসে ফুটফুটে দুই সন্তান। তাদের একজন সালিম সাদমান ধ্রুবর বয়স এখন ১২ এবং সাদিক সাদমান লুব্ধর ৯ বছর। পড়ালেখা চলছিল ইংরেজি মাধ্যমের একটি স্কুলে।
একপর্যায়ে সুখের সংসারে নেমেছে দাম্পত্য কলহ। ২০১৭ সালের ১২ মে শবেবরাতের রাতে তালাকনামায় স্বাক্ষর নিয়ে মল্লিকাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় বলে দাবি কামরুন্নাহারের আইনজীবীর। আর ওই ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ আগেই ছেলে দুটিকে তাদের ফুফুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেন মেহেদী। এরপর থেকেই সন্তানদের সঙ্গে তাদের মায়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ধ্রুব ও লুব্ধ এখন ফুফুর হেফাজতেই মাগুরার মহম্মদপুরের একটি কিন্ডারগার্টেনে পড়ালেখা করছে। আর মেহেদী হাসান একটি ব্যবসা নিয়ে থাকেন রাজধানীর উত্তরায়।
এ অবস্থায় কামরুন্নাহার দুই সন্তানকে নিজ হেফাজতে নেওয়ার দাবিতে হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৯ মে শিশু দুটিকে হাইকোর্টে হাজির করতে শিশু দুটির বাবা এবং মহম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে শিশু দুটিকে কেন তাদের মায়ের হেফাজতে দেওয়া হবে না. তা জানতে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। গতকাল নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ শিশু দুটিকে হাজির করে।
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত শিশু দুটির বক্তব্য শুনতে চায়। ধ্রুব আদালতকে বলে, ‘আমরা বাবা-মাকে একসঙ্গে দেখতে চাই। আর কিছু চাই না।’ শিশু দুটির বক্তব্য শুনে আদালত ফের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনেন। এ সময় মল্লিকার আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতকে বলেন, ‘আজকে একটা বছর ধরে মা তার সন্তানকে দেখতে পাচ্ছেন না। আজকে যখন কোর্টে হাজির করা হয়েছে, তখনো শিশুর ফুফু তাদের মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বাধা দিয়েছেন।’ এ সময় তিনি সন্তানদের সঙ্গে মায়ের কথা বলার সুযোগ চান।
পরে আদালতের অনুমতি পেয়ে মা দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছেলেরাও দীর্ঘদিন পর মাকে পেয়ে আনন্দে কাঁদতে থাকে। ধ্রুব তার মাকে বলে, ‘ঈদে তুমি ফোন করনি কেন?’ জবাবে মা বলেন, ‘ফোন করেছি; কিন্তু তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে দেয়নি বাবা।’ বড় ছেলে ধ্রুব তখন হাত বাড়িয়ে বাবাকেও ডাকতে থাকে। আর বলতে থাকে, ‘বাবা তুমি এসো। তুমি আমার কাছে এসো। আম্মুকে সরি বল।’ এ সময় বাবাও এগিয়ে এলে আদালতের ভেতর এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। বাবা-মা এবং তাদের সন্তানদের একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য দেখে আদালতে উপস্থিত বিচারক, আইনজীবীসহ সবার চোখে পানি আসে। আর এই পরিবেশ সবার বিবেককে নাড়া দেয়।
এ সময় আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক ওই শিশুদের এজলাসের ঠিক সামনে ডেকে নেন। সঙ্গে মাকেও কাছে ডাকেন। তখন বাবা-মাকে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুড়ে দেন ধ্রুব। আদালত তখন তার মাকে বলেন, ‘আপনি তো কলেজশিক্ষিকা, আপনার বাচ্চারা কী চাচ্ছে শুনতে পাচ্ছেন? ওরা কাস্টডি চায় না। আপনাদেরকে একসঙ্গে দেখতে চায়।’ এরপর বিচারপতিরা মেহেদী হাসানকেও এজলাসের সামনে ডেকে নেন। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি বলেন, ‘দুজনই আদালতে এসেছেন বাচ্চাদের শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে। আমার ৩০ বছরের পেশাগত জীবনে এমনটি দেখিনি। শুভাকাক্সক্ষী হলে সমঝোতা করে মিলে যান।’ এ সময় দুই বাচ্চা বাবা-মাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
পরে বেশ কয়েক আইনজীবী দাঁড়িয়ে জানান, যে অবস্থা, তাতে বাবা-মা সমঝোতা করতে পারেন। আদালতকে তারা সমঝোতার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতেও বলেন। এর পর আদালত বাচ্চা দুটির নানি ও ফুফুকে ডেকে কথা বলেন। পরে খাসকামরায় স্বামী ও স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে কথা বলে বেরিয়ে এসে আদেশ দেন।
আদেশে আদালত বলেন, ‘সবাই বাচ্চা দুটির কল্যাণ চায়। তারা আবারও দাম্পত্য জীবন শুরু করতে রাজি হয়েছে। ৪ জুলাই পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হলো। এ সময় পর্যন্ত বাচ্চা দুটি তাদের মায়ের কাছে থাকবে। আর বাবা ইচ্ছে করলে যে কোনো সময় তাদের কাছে যেতে পারবেন।’ আদেশের পর আদালত ধ্রুব ও লুব্ধকে ডেকে বলেন, ‘তোমরা কার সঙ্গে যাচ্ছো জানো? তোমরা তোমাদের মায়ের সঙ্গে যাবে। আর তোমাদের বাবাও যে কোনো সময় তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। তোমরা দেখবে তোমাদের বাবা-মা কী করেন। আবার ৪ জুলাই তোমরা সবাই কোর্টে আসবে। এসে তোমরা তোমাদের বাবা-মায়ের ব্যাপারে রিপোর্ট করবে, বুঝেছ?’
এ সময় ধ্রুব আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে যায়। আদালতে শিশু দুটির বাবার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন তাপস বল। মায়ের পক্ষে ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। সঙ্গে ছিলেন একেএম রিয়াদ সলিমুল্লাহ।