অনলাইন ডেস্ক :বাংলাদেশে যে কোনো মানুষকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার প্রিয় ফল কী? অধিকাংশের উত্তরই হবে ‘আম’। মিষ্টি স্বাদ, মন মাতানো গন্ধের জন্য একে বলা হয় ফলের রাজা। এক আমেরই রকমারি জাত, বাহারি গন্ধ আর অসাধারণ স্বাদ পৃথিবীর আর অন্য কোনো ফলে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। সে কারণেই আম অতুলনীয় এক ফল।
খোসা ছাড়িয়ে পাকা আমের রসালো শরীরে দাঁত বসানোর কী যে মজা তা বলে বোঝানো যাবে না! তরকারি বা ডালে ভিন্ন স্বাদ আনতে কাঁচা আম দেওয়া হয়। তা ছাড়া কাঁচা ও পাকা আম দিয়ে জ্যাম, জেলি, স্কোয়াশ, চাটনি, আচারসহ বিভিন্ন ধরনের মজাদার খাবার উপাদান তৈরি করা হয়। তবে আম খাওয়ার সময় এ আম কার্বাইড দিয়ে পাকানো কি না এ আতঙ্কেও ভোগেন ক্রেতারা। অবশ্য বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি আবিষ্কার করে কীটনাশকমুক্ত ভালো জাতের আম চাষ নিশ্চিত করেছে।
আম গাছ বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ। আর ভারতের এটি জাতীয় ফল। মৌসুমি ফল হলেও, এর স্থায়িত্ব বছরের তিন থেকে চারমাস। এ ছাড়া ফ্রিজেও রাখা যায়। স্বাদ নষ্ট হয় না। তাই অনেকেই সারা বছরই নিতে পারেন আমের স্বাদ। বাংলাদেশে আমের ফলন ভালো হয় রাজশাহী অঞ্চলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সবচেয়ে উন্নতমানের আম উত্পাদন হয়। আমের অন্যান্য জাত ছাড়াও বিশেষ করে রাজশাহীর ফজলি বিখ্যাত। ফজলিকে বলে ‘আমের রাজা’। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমের জন্য বিখ্যাত। ‘কানসাট আম বাজার’ বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় আম বাজার হিসেবে পরিচিত। তা ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে মহানন্দার নদীর তীরে নৌকার আম বাজারেরও রয়েছে বেশ নামডাক।
‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি ও আম গবেষণা :রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ ২০ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতিতে আম উত্পাদিত হচ্ছে। নিরাপদ, বিষমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য আম উত্পাদিত হওয়ায় ইতোমধ্যে এ পদ্ধতি বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর এই পদ্ধতিতে আম চাষের উদ্ভাবন ঘটেছে দেশেই।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশে আম উত্পাদনে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতির জনক চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শরফ উদ্দিন ইত্তেফাককে বলেন, ২০১৪ সালে চীনের একটি কোম্পানি আমাদের গবেষণার জন্য কিছু ফ্রুট ব্যাগ প্রদান করে। পরে আমরা গবেষণা কেন্দ্রে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করে আম উত্পাদনে ভালো সাফল্য পেয়েছি। তিনি বলেন, সাধারণত একটি আম গাছে বিভিন্ন ধরনের যেসব কীটনাশক স্প্রে করা হয়, তার যে খরচ, তার চেয়ে ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহারের খরচ সাশ্রয়ী। এ পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে বিষমুক্ত আম উত্পাদন সম্ভব এবং এতে আম বাগান মালিক বা চাষিরা অধিক বেশি লাভবান হন। নিরাপদ ও বালাইমুক্ত আম দেশীয় ভোক্তাসহ বিদেশের ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম উত্পাদন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে তিনটি গবেষণা কেন্দ্র এ পর্যন্ত আমের ১১টি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। এরমধ্যে ৮টি জাত উদ্ভাবন করেছে আঞ্চলিক উদ্যান তত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এগুলো হচ্ছে, বারী আম-১, বারী আম-২, বারী আম-৩, বারী আম-৪, বারী আম-৬, বারী আম-৭, বারী আম-৮ ও বারী আম-৯। এছাড়া যশোর কেন্দ্র ‘বারী আম-৫’, খাগড়াছড়ি কেন্দ্র ‘বারী আম-১০’ এবং পাহারতলী চট্টগ্রাম কেন্দ্র ‘বারী আম-১১ (বারো মাসী)’ উদ্ভাবন করেছে।
আম উত্পাদনে বাংলাদেশ নবম :চলতি বছরে ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস বিশ্বে আম উত্পাদনে সর্বোচ্চ দেশগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। সে তালিকা অনুযায়ী আম উত্পাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে রয়েছে। আম সবচেয়ে বেশি উত্পাদন হয় ভারতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আম উত্পাদনকারী দেশ চীন, তৃতীয় থাইল্যান্ড, চতুর্থ মেক্সিকো, পঞ্চম ইন্দোনেশিয়া, ষষ্ঠ পাকিস্তান, সপ্তম ব্রাজিল, অষ্টম মিসর, দশম নাইজেরিয়া। যদিও তারা ২০১৩ সালে উত্পাদনের হিসাবে এ তালিকা করেছে। সে তুলনায় এখন বাংলাদেশ ২০১৩ সালের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ আম উত্পাদন করছে।
কোন আম কখন পাবেন:বাংলাদেশে আম বসতবাড়ির গাছ। আর কোন গাছ লাগানো হোক বা না হোক বসতভিটায় আম গাছ থাকবেই। এখন সারাদেশেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আম চাষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে আমের প্রধানত দুটি জাত রয়েছে। একটি জোড় কলমের সাহায্যে উন্নত জাতের আম অপরটি আটি বা গুটি আম যা দেশি আম বলেই পরিচিত। বিশ্বে প্রায় সাড়ে তিনশো জাতের আম রয়েছে বলে জানা যায়। বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে দামি আম ‘আলফানসো’। এটি মূলত ভারতে চাষ করা হয়। মিয়ানমারের জনপ্রিয় আম ‘রাঙ্গু’ দেখতে আকর্ষণীয়, খেতে সুস্বাদু। ‘কোহিতুর’ নামের একটি আম নবাবদের খুব পছন্দের ছিল। আম গ্রীষ্মকালীন ফল হলেও শীতকালে খাওয়া হত সেই আম। এই আম সংরক্ষণ করা হত ঘি আর মধুতে। যারা আম ভালোবাসেন তারা রীতিমত দাঁতে ধার দিয়ে অপেক্ষা করেন কখন নামবে আম। সেই আম বাজারে আসারও নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। ইদানিং আগ্রাসী ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় অপোক্ত আমকেই কার্বাইড দিয়ে পাকিয়ে বাজারে ছাড়ছে। তবে সাধারণত মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বাজারে আম পাওয়া যায়। গোবিন্দভোগ আম ২৫ মের পর থেকে বাজারে আসে, গোপালভোগ আসে পহেলা জুনের পরে, রানিপছন্দ আসে ৫ জুলাইয়ের পরে, হিমসাগর ও ক্ষিরসাপাতি আসে ১২ জুনের পরে, ল্যাংড়া জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে, হাড়িভাঙ্গা ও লক্ষণভোগ জুনের তৃতীয় সপ্তাহে, আম্রপালি আর মল্লিকা আসে জুলাইয়ের শুরুতে, ফজলি জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আর সবশেষে আসে আশ্বিনা ২৫ জুলাইয়ের পরে।
আমের বাহারি নাম: আমের নামের যে কত বাহার। ল্যাংড়া, ক্ষিরসাপাতি, সিন্দুরা, চোষা, রাজভোগ, গোপালভোগ, ফজলি, আম্রপালি, হাঁড়িভাঙ্গা, কাঁচামিঠা, হিমসাগর, লক্ষণভোগ, দুধসাগর, গোবিন্দভোগ, গুলাবখাস, গুটি, সুন্দরী, বোম্বাই, মল্লিকা, লখনা, আশ্বিনা প্রভৃতি। আসলে আমাদের দেশে আমের বাহারি জাত হলেও, এসব আমের নামকরণ কোনোটাই ঐতিহাসিক না। কেবল কিছু আমের নামকরণ বাণিজ্যিকভাবে হয়ে এসেছে। তা-ও সেই নামকরণগুলো অ্যাকাডেমিকভাবে হয়নি। লোকমুখে ছড়ানো নামগুলোই সবাই নিয়েছে।
ক্ষিরের মতো মিষ্টি যে, আমের স্বাদ তার নাম ক্ষিরসাপাতি। রানী যে আম খেয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছেন, সেই আমের নাম রানীভোগ। বিহারের এক ল্যাংড়া ফকিরের বাড়ি থেকে যে আমের সন্ধান মিলে, তার নাম হয়ে যায় ল্যাংড়া। যে আমটা কাঁচা থাকতে মিষ্টি হয় তার নাম কাঁচামিঠা। দুধ ভাতের সাথে আম মিশিয়ে খেতে পছন্দ করেন অনেকেই। দুধভাতের আমের নাম হয়ে গেল তাই দুধসাগর। চোষা আম বাংলাদেশের না। ইন্ডিয়াতেই এর উত্পত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে পাওয়া যায় অনেক আগে থেকেই। আকারে ছোট এ আম যেমন মিষ্টি তেমনি এতে আঁশের পরিমাণ খুবই কম। আবার অঞ্চলভেদে কিছু আমের একাধিক নামও এসেছে মানুষের ব্যবহারে। যেমন ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে রসুনে আম বলা হয় এক জাতের আমকে। তার স্বাদ যেমনি হোক, রসুনের মতো গন্ধ বলে তার নাম রসুনে আম। এভাবে প্রায় আমেরই অদ্ভুত নামকরণ হয়ে গেছে।