রাজনীতির উত্থান-পতনের কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৮ বছরে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসকে। ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। স্বাধীনতাত্তোর প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করে বিভ্রান্ত করা হয়েছে বারংবার
আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীনতাত্তোর প্রজন্ম। আমার জন্ম গত শতকের আশির দশকের শেষের দিকে। জন্মের পর জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন বোঝার জ্ঞান না হলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারা বেশ ভালোভাবেই দেখেছি, শিখেছি, বুঝেছি। গণতান্ত্রিক যুগের বাংলাদেশেও দেখেছি নানা উত্থান-পতন।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল রংধনুর মতো রঙিন। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীনতার রূপকারকে ঘৃণ্যভাবে হত্যা করে কখনো দেশে এসেছে সামরিক শাসন। কখনোবা সামরিক শাসকেরাই উর্দি খুলে করেছে গণতন্ত্রের চর্চা! আবার কখনো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার চেয়েছে ছলে-বলে অগণতান্ত্রিক উপায়ে টিকে থাকতে।
রাজনীতির এই উত্থান-পতনের কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী ৪৮ বছরে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসকে। ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে বারবার। স্বাধীনতাত্তোর প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করে বিভ্রান্ত করা হয়েছে বারংবার।
স্কুলে যখন পড়ানো হতো – বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ এবং জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ২৭ মার্চ – ইতিহাসকে তখন অংকের চেয়েও জটিল বিষয় বলে মনে হতো!
১৯৭৫ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর পরবর্তী ২০ বছর ধরে চলতে থাকে এই মিথ্যাচার। অতঃপর ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে অনেক প্রকৃত ইতিহাস বের হয়ে আসতে থাকে। বিস্ময় বাড়তে থাকে আমাদের প্রজন্মের। এতটাই ভুল, এতটাই ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে ছিলাম এতদিন!
এরপর ক্ষমতার পটপরিবর্তনে অনেক কিছু বদলে যায়। ২০০৯ সালে নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আবারো সরকার গঠন করে আওয়ামীলীগ।এসময় বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নানান সত্য ইতিহাস উঠে এসেছে। কোনটি আমরা মনে রেখেছে কোনটি ঠিক তেমন করে রাখিনি।
ঠিক তেমনি একটি বিষয় – বাংলাদেশের নামকরণ। আমরা ক’জনই বা জানি আমাদের এই দেশটার নামকরণের ইতিহাস?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বিবিসি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে “বাংলাদেশ” শব্দের উৎপত্তিগত ব্যাখ্যা দেন।
“বাংলা” শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃত শব্দ “বঙ্গ” থেকে। আর্যরা “বঙ্গ” বলে এই অঞ্চলকে অভিহিত করতো। পরবর্তীতে বঙ্গে বসবাসকারী মুসলমানরা এই “বঙ্গ” শব্দটির সঙ্গে ফার্সি “আল” প্রত্যয় যোগ করে। এতে নাম দাঁড়ায় “বাঙাল” বা “বাঙ্গালাহ্”।”আল” বলতে জমির বিভক্তি বা নদীর ওপর বাঁধ দেওয়াকে বোঝাতো।
ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের উদ্ধৃতি দিয়ে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, “মুসলমান শাসনামলে বিশেষ করে ১৩৩৬ থেকে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমলে এবং ১৫৭৬ সালে মোঘলরা বাংলা দখল করার পরে এই অঞ্চলটি বাঙাল বা বাঙ্গালাহ্ নামেই পরিচিতি পায়।”
এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজারা দখলদারিত্বের সময় এই বাংলাকে বিভিন্ন নাম দেন। এই অঞ্চলের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামের মতো কয়েকটি প্রেসিডেন্সি নিয়ে নাম দিয়েছিলেন “বঙ্গ”।
ব্রিটিশ শাসনামলে এই অঞ্চলের নাম হয় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। এরপর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় গোটা বাংলায় একটা প্রশাসনিক বিভাজন হয়। বাংলার পশ্চিম অংশ হয়ে যায় পশ্চিম বঙ্গ ও পূর্ব অংশ হয়ে যায় পূর্ব বাংলা।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর ১৯৪৭ সালে বঙ্গ-প্রদেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হল। সেসময় পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার নাম দেয় পূর্ব পাকিস্তান।
মূলত তখন থেকেই বিতর্ক শুরু হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় এবং তীব্র আন্দোলনের মুখে বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
এরপর ১৯৫৭ সালে করাচিতে পাকিস্তানের গণপরিষদের তরুণ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দেওয়ার সময় “পূর্ব পাকিস্তান” নামটির প্রতিবাদ করে বলেন যে, পূর্ব বাংলা নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে।
“আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নেবে কিনা – সেজন্য গণভোট নিতে হবে।”
এরপর আসে ১৯৬৯ সাল। শুরু হয় পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন। পূর্ব বাংলা তখন বিক্ষোভে উত্তাল। এই অঞ্চলের জনগণ ততদিনে বুঝে গেছে স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
ইতিহাস অনুযায়ী, সেই উত্তাল সময়েই প্রথমবারের মতো পূর্ব বাংলাকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করা হয়।
১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, “আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ”।
বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনে লেখা ডায়েরি নিয়ে রচিত ‘‘কারাগারের রোজনামচা”বইয়ের একটি অংশে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন পরিচয় (১৯৫৫-৭৫) বর্ণনা করা হয়।
সেখানে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু সেই সভায় বলেন, ‘‘এক সময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।…একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনও কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই।…জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।”
এবছর ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সেই বাংলাদেশ নামকরণের সুবর্ণ জয়ন্তী। দুঃখের বিষয় ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য যে নাম আমরা পেলাম, তা খুব কম মানুষই জানি। অথচ যা উদযাপিত হওয়া উচিত ছিল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ স্বাধীনতাত্তোর প্রজন্মের কিছু মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটির সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের এই উদ্যোগকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে সাধুবাদ জানাই।
দিনটিকে পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় উদযাপন করা হবে, এই আশা রাখি। তাছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পাঠ্যপুস্তকেও নামকরণের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাই।
আনন্দ মোস্তফা, ঢাকা ট্রিবিউনের বাংলা বিভাগের প্রধান
**************************************************************************************************************
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনও ধরনের দায় নেবে না।