ইংরেজি মিডিয়ামে ভর্তি করানোর সময়ই মেয়েকে বিলেতে পড়ানোর ইচ্ছার ছোট্ট একটা পেরেক ঠুকে রেখেছিলেন মস্তিস্কে। ইচ্ছারা গোপনে শাখা-প্রশাখা মেলেছে। ক্রমশ তা দখল করে নিয়েছে নিজের আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা আর উৎসাহ। অন্তরের এসব আলোর প্রকাশ ছিল না বাইরে। মেয়ে রোজ স্কুলে যায়, ধীরে ধীরে ছোট্ট শিশুটি টিনএজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে। কখন তার পোশাক আর কথা বলার ঢঙে পরিবর্তন ঘটেছে- টেরই পাননি। তবে শিশুকালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে মেয়ের কথার টান আর উচ্চারণের ইংরেজি মাখানো শিশুতোষ ভঙ্গিটায় ধাক্কা খেতে খেতে সহনশীল হয়ে গিয়েছিলেন। এ মুহূর্তে বাবার সামনে এসে পিয়া বলল, ‘আমার ফ্রেন্ডরা লন্ডন যাচ্ছে। আমার কী হবে, আব্বু?’
পিয়ার কথায় চমকে উঠলেন বাবা ফেরদৌস আহমেদ। বাংলা বলছে মেয়ে। কথার টোনে অন্যরকম ইংরেজি ইংরেজি ভাব থাকলেও মেয়ের কণ্ঠে বাংলা শুনে প্রীত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন যাচ্ছে? বেড়াতে?’
“কী বলছ! ‘এ-লেভেল’ শেষ করে লন্ডনে বেড়াতে যাবে কেন ওরা?”
‘ওঃ। হ্যাঁ। এ বয়সে পড়তেই তো যাবে। পড়তে যাচ্ছে?
হ্যাঁ।
স্কলারশিপ পেয়েছে তারা?
‘না। না। কেউ স্কলারশিপ পায়নি। সবাই বাবার টাকায় পড়তে যাচ্ছে।’
‘আচ্ছা। আচ্ছা। তুমিও তা চাও?’
‘ডেফিনিটলি, ড্যাড।’ পিয়ার কথার ভেতর থেকে ইংরেজি শব্দ বেরোচ্ছে দেখে ফেরদৌস আহমেদ বললেন, ‘তুমিও যাবে। ঠিক আছে। যোগাযোগ করেছ বিলেতের কোনো ভার্সিটির সঙ্গে?’
‘হ্যাঁ। দু’মাস পর থেকে সেশন শুরু হবে। গেট রেডি, ড্যাড।’
‘কীভাবে রেডি হতে বলছ?’
‘সহজে ভিসা পাওয়ার জন্য তোমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যান্ডসাম হতে হবে। ঘাটতি থাকলে অ্যাকাউন্ট ভরে নাও। অ্যাটলিস্ট কিপ টেন মিলিয়ন। কমপক্ষে ফিফটি লাখ তো রাখতেই হবে। আই থিঙ্ক ইট ইজ পসিবল অন ইওর পার্ট। কী বলো, বাবা?’
মেয়ে একবার ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করছে, আবার ড্যাড বলছে। বাংলায় বলছে, আবার ইংরেজিতে। এর অর্থ পিয়া যা বলছে তা করতেই হবে। এ অভ্যাসটা তিনি দেখে এসেছেন তার ছোটবেলা থেকে। যখন যা চেয়েছে, পেয়েছে। ‘না’ বলে কোনো শব্দ জমা হয়নি তার মস্তিস্কে। চাওয়ামাত্র না পেলে ভয়াবহ রকম রাগ ওঠে পিয়ার। সে-রাগ কখনও অন্যের ওপর ঝাড়ে না। নিজের ওপর আক্রমণ করে সে। ডান হাতে ধারালো ব্লেড বা ছুরি নিয়ে পোচ দেয় নিজের বাঁ কবজির খানিকটা উপরে, সামনের দিকে। রক্তাক্ত অবস্থায় মোটেই তার যাতনা হয় না, মা-বাবাই তখন হাহাকার করে ওঠেন। তার দাবি মানতে বাধ্য হন।
অ্যাকাউন্টে এত টাকা নেই, নিশ্চিত তিনি। তার পরও এ মুহূর্তে কোনো প্রশ্ন না করেই মেয়ের দাবি মেনে নিলেন বাবা। ভেতরের পুষে রাখা ‘গোপন ইচ্ছা’ আর ‘মেয়ের দাবি’ দুটোই সম্পূরক শক্তি হিসেবে আক্রমণ করল সামর্থ্যের ভিত।
দাবি পূরণের স্বীকৃতি পাওয়ায় পিয়া চট করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস প্রকাশ করল। আর বলল, ‘ইউ আর রিয়েলি গুড পাপা, রিয়েলি সুইট, রিয়েলি গ্রেট!’
পিয়ার মা কেয়া আহমেদ দূরে দাঁড়িয়ে শুনেছেন বাবা-মেয়ের কথা। মেয়ে বাবার সামনে থেকে সরে যাওয়ার পর সামনে এগিয়ে এসে তিনি বললেন, ‘সহজে সব কথা মেনে নিলে?’
‘না মেনে উপায় আছে?’
‘সামর্থ্য আছে কিনা ভাববে না? ছেলের কথা ভাববে না?’
স্ত্রীর কথায় দুশ্চিন্তার ঘণ্টা বেজে উঠল মস্তিস্কে। তবে মেয়ের দাবির কাছে নতজানু হলেও দুঃসাধ্য প্রতিজ্ঞা করেননি। সামর্থ্য যে একেবারে নেই, তা নয়। তবে বাংলাদেশের টাকার বিনিময়ে পাউন্ড কিনে সেই পাউন্ডে লন্ডনের সেরা কোনো ভার্সিটিতে সন্তান পড়ানোর জন্য মাসে যে পরিমাণ পাউন্ড ব্যয় করতে হবে, তা ভাবনায় ফেলে দিল। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন, নিজের আর্থিক অবস্থা যতই ভালো হোক, বিদেশি মুদ্রার চাপে নিজেদের টাকার মান যে চাপা পড়ে যায়, তা থেকে শ্বাস নেওয়া কঠিন। বিদেশে গেলে দু’দেশের মুদ্রার বিশাল ব্যবধানের কারণে নিজেকে দরিদ্রই মনে হয়। দরিদ্র দেশের দরিদ্র জনগণের সোনার সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার আশা অযৌক্তিক, অবাস্তব। তা মনে করিয়ে দিল ইংরেজি প্রবাদ ‘কাট ইওর কোট, অ্যাকর্ডিং টু ইওর ক্লথ।’ স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মনে মনে হিসাব কষতে লাগলেন। কোথায় কত টাকা ডিপোজিট আছে, মেলাতে গিয়ে ঘেমে উঠলেন তিনি।
‘তোমার ব্যবসার অবস্থাও তো স্ট্যাবল না। নানা খাতে কত কত টাকা ঋণ নিয়েছ, কত করে মাসিক কিস্তি কাটছে, ভেবেছ? বড় বড় লস খেয়ে তো কখনও কখনও বিছানায় পড়ে গিয়েছিলে, মনে আছে? ব্যবসার আয় সন্তোষজনক না হওয়ার আগে বড় ব্যয়ের ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হবে? ভেবেছ এসব?’
প্রতিটা প্রশ্ন বুলেটের মতো আক্রমণ করতে লাগল ফেরদৌস আহমেদের মাথায়। তার পরও তিনি ভেঙে না গিয়ে বললেন, ‘দেখি কী করা যায়। মাসিক কত খরচ হবে তাকে সেখানে পড়ানোর জন্য, হিসাব-নিকাশ করে দেখি। সারপ্লাস আয় না থাকলে তো কঠিনই হবে। তবে মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে তো হবেই। ঝুঁকি নিতে হবে।’
‘বাড়তি আয়ের চাপ কি বাতাসের ওপর দিয়ে যাবে? শরীরে ধকল সইবে তো! একবার ত্রিশ লাখ টাকা লস খেয়েই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে ঘুরে এসেছ। বাড়তি চাপ, বাড়তি চিন্তার বোঝা টানতে পারবে তো তোমার হার্ট! আগে সব চেক করিয়ে নাও। তারপর এত বড় সিদ্ধান্ত নাও। এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যেও না।’
‘দেখি, কী করা যায়।’
‘দেখি দেখি বললে হবে না। ছেলের জন্যও টাকা মজুদ রাখতে হবে। কী কাজে যেন প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকা জোগাড় করে রাখতে বলেছে।’
‘কী কাজে ওর এত টাকা লাগবে?’
‘সব খুলে বলেনি। পরে বলবে বলেছে। এ জন্য বলছি, মেয়ে যদি স্কলারশিপ পায়, সম্মতি দেওয়া যেতে পারে। তার পরও বিপদের আশঙ্কা কম থাকে না। আনম্যারেড অবস্থায় লন্ডনের মতো শহরে পড়তে যাওয়া চাট্টিখানি কথা না। সেখানে নানা সংকটে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ছেলেমেয়েরা এক ডর্মেও থাকে শুনেছি। অশোভন নানা ঝামেলার কথাও জেনেছি এর আগে। সব মিলিয়ে মেয়েকে বিদেশে পাঠানোর পক্ষে না আমি। মেয়ের ভালোর জন্যই কথাগুলো বলছি। ওর ফ্রিডমের লেজ টেনে ধরতে হবে।’
চমকে উঠলেন ফেরদৌস আহমেদ। কঠোর পরিশ্রম করে ব্যবসা চালাচ্ছেন। আয় করছেন। রক্তঝরা আয়ই বলা চলে। এই আয়ে খরচের খাত লাগামহারা হলে ভবিষ্যৎটা বিপদঘন হতে পারে। বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- ভেবেও অসহায়ভাবে বললেন, ‘কখনো তো মেয়ের দাবি উপেক্ষা করিনি। এটাও বোধ হয় এড়াতে পারব না।’
‘সব অযৌক্তিক দাবি পূরণ করে করেই তো ওর চাহিদার সীমা আকাশে তুলে দিয়েছ। এখন তোমার সামর্থ্যের সিঁড়ি বেয়ে সেই উঁচু চাহিদা ও আর ধরতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। সবাই নিশ্চয় চাপে পড়ে যাব। চাপ বয়ে বেঁচে থাকাও কঠিন।’
‘অনেকে তো কাজ করে সেখানে পড়াশোনার টিউশন ফি জোগাড় করে। প্রয়োজনে পিয়াও করবে।’
‘বাহ্! বাহ্! শেষ পর্যন্ত মেয়েকে পিঁয়াজ কেটে আর প্লেট ধুয়ে পড়াশোনা করতে হবে! বাহ্!
স্ত্রীর কথার ঝাঁঝের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে হতাশা। স্বামীকে অপমান করার জন্য মেজাজ-ছেঁড়া কথা বলছেন না তিনি। বুঝতে অসুবিধা হলো না ফেরদৌস আহমেদের। চুপ করে থাকলেন তিনি।
‘আমার এক ফ্রেন্ডের ছেলে লন্ডনে পড়ে। মাসে প্রায় প্রায় দুই লাখ টাকা ক্যাশ পাঠাতে হয়। এই ফি, সেই ফি তো আছেই। ওখানে বড় বড় ভার্সিটি পাসও করাতে চায় না ছাত্রছাত্রীদের। যত বেশি ফেল করবে, তত বেশি লাভ ভার্সিটির। পড়াশোনা ফাঁকি দেওয়ার কোনো স্কোপ নেই। আর কাজ করে পড়াশোনা চালাতে চেষ্টা করে থাকে অনেকে। ভালো ফল করতে পারে না তারা। হতাশায় ভোগে। নানা রকম অনিয়মে জড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়- মেয়েকে বিদেশে পাঠানোর আগে এসবও ভাবতে হবে।’
স্ত্রীর একটা কথাও ফেলে দিতে পারলেন না তিনি। আবার নিজের চাহিদার স্রোতে ভাসতে থাকা গোপন ইচ্ছাও মাথা তুলছে। লন্ডনে পড়বে মেয়ে, ব্যারিস্টারি করে দেশে ফিরবে, স্ট্যাটাস বেড়ে যাবে মেয়ের, নিজেরও- এসব চিন্তাস্রোতও ছুটছে সামনে, অগ্রগামী গাইড হিসেবে তা সাজিয়ে দিচ্ছে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা- হাজারো সমস্যা পেরিয়ে মেয়েকে বিলেতে পড়ানোর আকাঙ্ক্ষার কাছে হেরে গিয়ে মেয়ের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয়টা জোরালো হলো নিজের মনে।
দুই.
ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ানোর জন্য টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কিছুটা হিমশিম খেয়ে গেলেও হাল ছাড়লেন না ফেরদৌস আহমেদ। নিজের সব অ্যাকাউন্ট হিসাব করে দেখলেন ৪০ লাখের মতো জমা দেখাতে পারবেন। আর জানেন স্ত্রীর নামে ফিক্সড ডিপোজিট আছে দশ লাখেরও কিছু বেশি। ওটা ভাঙালে হবে ৫০ লাখ। আরও ৫ লাখের মতো বাড়তি রাখা উচিত। বাড়তি টাকা জোগাড়ের চাপে থাকলেও ভড়কালেন না তিনি। তবে স্ত্রীর টাকাটা হাতে পেতে কৌশলী হতে হবে, বুঝলেন। মেয়ে অন্তঃপ্রাণ মা, কোনোমতেই পিয়াকে বিদেশে পাঠাতে রাজি নয়। অনড় অবস্থান থেকে এখনও টলানো যায়নি তাকে। টাকার কথা তুললে আবার কী বিপদ ঘটে ভেবে ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠলেও মধুর এক মুহূর্তে খাবার টেবিলে খোলামেলা তুলে ধরলেন সমস্যার কথা। সব শুনে কেয়া আহমেদ বললেন, ‘তুমি তো চাপই নিচ্ছ। উচিত হচ্ছে?’
‘একই প্রশ্ন আগেও করেছিলে।’
‘হ্যাঁ। বার বার প্রশ্ন করছি। করতে থাকব। এ বয়সে চাপ নেওয়া বিপজ্জনক। অনেকের জীবনে অনেক রকম সমস্যা আর বিপর্যয় দেখেছি বাড়তি চাপের কারণে।’
‘হ্যাঁ। ঠিক বলেছ। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে আমার আশাটা পূরণ করতে সাহায্য করবে না তুমি?’
‘সেকি? আমি কীভাবে সাহায্য করব? রোজগার করছ তুমি, তোমার ওপর তো নানামুখী চাপ বাড়তেই থাকবে।’
‘বলছিলাম কি, তোমার নামে যে দশ লাখ আছে তা ভাঙিয়ে আপাতত আমার অ্যাকাউন্টে জমা দিই। তাহলে ব্যাংক ব্যালান্সটা আরও উঁচু হবে। মেয়ের ভিসা পেতে ওটা খুবই দরকারি। পরে তোমারটা আবার ফিক্সড করে তোমার নামেই রেখে দেব।’
‘তোমার ইচ্ছা অপূর্ণ থাকুক তা চাই না আমি। মেয়েকে বিদেশ পাঠাতে আমি রাজি না থাকলেও তুমি যা বলবে তাই-ই হবে। তবে অতিরিক্ত চাপ নিতে পারবে না ভবিষ্যতে, বলে রাখলাম।’
আনন্দে চোখ বুজে এলো ফেরদৌস আহমেদের। অনেকক্ষণ পর তাকালেন তিনি স্ত্রীর মুখ পানে। এত কাছের সে, কখনও এমন করে অনুভব করেননি। ঘরে আছে ঘরের বউ। এটাই ছিল বড় শান্তি। আজ বুঝলেন বউ কেবল তার নিজেরটাই দেখে না, স্বামীর জন্য ভালো চিন্তায়ও ডুবে থাকে। অন্যরকম অনুভবে ঋদ্ধ হয়ে নিজেকে আর নিজের গড়া সংসারটাকে পরিপূর্ণ ভাবতে পারলেন ফেরদৌস আহমেদ।
তিন.
পিয়াকে বিলাতে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসে নিজের অবিনাশী অহঙ্কার আপন শিকড়ে জল ঢাললেও বাস্তবতার ভার ঘাড়ে বসেছে চাপ রূপে। ভার বহন করতে পারছেন, আবার পারছেনও না। এসব কিছু শেয়ার করা যাচ্ছে না স্ত্রীকেও। তবুও ঘরের আবহাওয়া শান্ত আর নিথর নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে দেখে স্বস্তি পাচ্ছেন ফেরদৌস আহমেদ।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজের আশায় বসে থেকে এক কাপ গ্রিন-টি পানের তেষ্টাও চেপে ধরেছে জিভ। সংবাদপত্র পড়া আর চা পান করা প্রতি ভোরের অভ্যাস। অপেক্ষার ধৈর্য তার নেই বললেই চলে। ঠিক এ সময় ডোরবেলের শব্দ হওয়ায় কিচেনের ভেতর থেকে বেরিয়ে বুয়া দরজা খুলে আবার ফিরে এলো তার কাছে।
‘মাছওয়ালা আইছে খালু। চিতল আর বড় বড় চিংড়ি আনছে। খালাম্মার কথা মতো মাছ আনছে হে। রাখলাম। কী কন?’
‘কত, দাম জিজ্ঞেস করো।’
‘হেইডা আপনি জিগান।’
বসার ঘর থেকে সোফা ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে দেখলেন বিশাল এক চিতল ডালার মধ্যে শুয়ে আছে। পাশের আরেকটা ঝুড়িতে আছে গলদা চিংড়ি। ঝুড়ি প্রায় উপচে উঠছে।
‘কত?’
‘সব ৯ হাজার নয়শ’ টাকা।’ বলল মাছওয়ালা।
‘দশ হাজার বলো। বাটার দোকানের শু’র মতো দাম বলছ কেন?’ ধমক দিলেন ফেরদৌস আহমেদ।
মাছওয়ালা মাথা চুলকাল। তার মাথা গামছা মোড়ানো। শরীরে লেপটে আছে শীতের কাপড়। জবাব পাচ্ছেন না দেখে আবার তিনি বললেন. ‘দাম কমাও। নইলে যাও।’
মাছ বিক্রেতা সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এর আগে কখনও তিনি দামাদামি করেননি। আজ কী হলো সাহেবের? ভাবতে গিয়ে বোধশূন্য হয়ে বসে রইল সে।
কেয়া আহমেদ দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন। আজ উঠেছেন নির্ধারিত সময়ের আগেই। ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন দরজার মুখে মাছ বিছিয়ে বসে আছে মাছওয়ালা।
‘কী হয়েছে? মাছ না দিয়ে বসে আছ কেন?’
‘ছার, ফেরত দিছেন। কইলেন, মাছ নেবেন না।’
‘নেবে না বললেই হলো? তুমি বলোনি আমি অর্ডার দিয়েছি? বাসায় মেহমান আসবে, বুয়া বলেনি?’
‘কইছি খালাম্মা।’ পেছন থেকে এসে বলল বুয়া।
‘তবুও ফেরত দিলো?’
‘হ্যাঁ। ফেরত দিলাম।’ বসার ঘর থেকে এবার পেপার হাতে বেরিয়ে এসে বললেন ফেরদৌস আহমেদ। কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবার বললেন, ‘বাজেট কতল করো। সব সেক্টরে খরচের হাত সামলাও।’
‘ও। বাড়িতে আমার কোনো মেহমান এলে হাত গুটাতে হবে?’ বসার ঘরে ফিরে যাওয়া স্বামীর উদ্দেশে ঝাঁঝালো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন স্ত্রী।
‘শোনো, বিলেতে মেয়ের সেশন চার্জ ছয় মাস পর পর প্রায় ১২ লাখ টাকা, দু’সেশনে বছরে ২৪ লাখ। আর ডর্মের ভাড়া মাসে প্রায় এক হাজার পাউন্ড, অন্যান্য খরচ এক হাজার। মোট কত দাঁড়ায় হিসাব করতে পারো?’
‘মেয়েকে বিলেতে ভর্তি করানোর আগেই তো সতর্ক করেছিলাম, দু’পয়সার দাম দাওনি আমার কথার। পটিয়ে তো আমার টাকাগুলোও তুলে রেখেছ নিজের অ্যাকাউন্টে। ফেরত দেওয়ার কথা, দাওনি এখনও! আর এখন মাছের দাম কমানোর জন্য চাপ দিচ্ছ! কিপটেমি করছ? ছিঃ!’
‘কেবল মাছ নয়, সব কিছুর খরচই কমাতে হবে, কাটছাঁট করতে হবে। আমার দামও কমে গেছে মেয়ের কাছে। ঠিকমতো টাকা পাঠানো যাচ্ছে না। একসঙ্গে মাসে এক হাজার পাউন্ডের বেশি পাঠানো যায় না। সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে থাকা আত্মীয়কে টাকা দিলে, মেয়েকে লন্ডনে হাতে হাতে টাকা দিয়ে দেবে, এমন একজনকে পেয়েছি। তাতেও ঝামেলা। মেয়ে বোধ হয় ঠিক সময়ে টাকা পাচ্ছে না। সে পেরেশানিতে আছে। আর আমার শ্রমে রোজগারের টাকার জন্যও শোক জাগছে। এ সময় খরচপাতি সামলাতে হবে না?’
পেরেশানির কথা শুনে চুপসে গেলেন কেয়া আহমেদ। ছেলে পড়াশোনায় সুবিধা করতে না পেরে ব্যবসা করবে বলে ঠিক করে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। আগেই বলে রেখেছিল সে মাকে। চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ টাকার ব্যাপার। টাকা না পেলে বেপরোয়া হয়ে যেতে পারে সে। অথচ এ মুহূর্তে স্বামীর শক্ত অবস্থান ও হতাশা দেখে কথাটা শেয়ার না করে নিজেকে সামলে নিয়ে বসার ঘর ছেড়ে ফিরে এলেন নিজের ঘরে। স্ত্রীর যাওয়ার পর মাছ বিক্রেতার সামনে এসে ফেরদৌস আহমেদ সহজ কণ্ঠে বললেন, ‘দাও, মাছ দিয়ে যাও আজ। এরপর থেকে ছোট মাছ আনবে। কম দামি মাছ আনবে, বুঝেছ?’
চার.
মেয়ের কল পেয়ে অতলস্পর্শী মায়ার ছোঁয়া পেলেন তিনি। দিনমজুরের মতো কঠোর শ্রমে পার করা দিনগুলোর কথা ভুলে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কেমন আছো, মা? পড়াশোনা কেমন চলছে?’
‘তোমার চাপ আর কষ্ট কমানোর চেষ্টা করছি, অধিকাংশ সময় গ্রুপ স্টাডি করছি, লাইব্রেরি ওয়ার্ক করছি। বই কেনা লাগছে না। এখানে বইয়ের দাম অনেক বেশি, কল্পনাও করতে পারবে না তুমি। সবাই দলেবলে পড়ছি তো, ভালো আছি। ভালোই লাগছে লন্ডন। আনন্দে আছি।’
‘বাহ্। তুমি ভালো আছো শুনে আমারও ভালো লাগছে। আর টাকা খরচের ভয়ে বই না কিনে লাইব্রেরিতে পড়তে হচ্ছে শুনে নিজেকে হতদরিদ্র মনে হচ্ছে। আমার কষ্টের আয় তোমার পেছনে ঢালতে হচ্ছে, আর তুমি কিনা এত কষ্ট করছ!’
‘কষ্ট না, বাবা। এটা আনন্দ। গ্রুপে আনন্দ। আর এ দেশে এত সুন্দর জীবন-যাপন! দেশে কি আর তা জুটবে?’
‘বলো কী মা? দেশে থাকার আনন্দই আলাদা। পরদেশে তো নিজেকে ভিখিরি ভিখিরি লাগে। নিজেকে গড়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসবে, দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে, তার মতো সুখের বিষয় আর কী হতে পারে, মা?’
‘না, বাবা। এ দেশ ছেড়ে আর যেতে ইচ্ছা করবে না। আবার পাঁচ বছর থাকার পর ওরা এখন এ দেশে আর থাকতেও দিচ্ছে না। তবে অনেকে নানা কায়দায় পিআর জোগাড় করে ফেলে।’
‘পিআর কী, মা?’
‘পারমানেন্ট রেসিডেন্ট, স্থায়ী সিটিজেন হিসেবে বৈধভাবে এ দেশে থাকার ম্যান্ডেট।’
‘তোমার স্থায়ী সিটিজেনশিপ দরকার নেই। পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসবে তুমি।’
‘ও, পাপা! কাম অন! আই হ্যাব ক্রসড দ্য অ্যাইজ অব মেজরিটি, আই ক্যান হ্যান্ডেল মাই লাইফ হেয়ার, উইথ একস্ট্যাসি।’
‘আমাদের ছেড়ে থাকতে পারবে? বৈধ সিটিজেনশিপ কীভাবে পাবে?’
‘পারছি তো। পারছি না, কী বলো? আর ব্রিটেনের কোনো নাগরিককে বিয়ে করলে স্থায়ী সিটিজেনশিপ পেয়ে যাব।’
‘এসব কী বলছ, মা?’
‘আহা, পাপা এটাই সত্যি। তোমাদের মেয়ে সুখী আছে জানলে তোমরা সুখ পাবে। কষ্টে আছে শুনলে কষ্ট পাবে। তাই না? আমাকে সুখী দেখতে চাও না তোমরা?’
মায়ার শিকড়ে টান খেলেন ফেরদৌস আহমেদ। পাঁজরের হাড়গোড় ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হলো, তোমাকে সুখী দেখতে চাই। দেশে ফিরে সুখী হও। বলতে পারলেন না তিনি।
বাবাকে চুপ থাকতে দেখে মেয়ে আবার বলল, ‘আমি এর মধ্যে ব্রিটেনের স্থায়ী এক সিটিজেনের সঙ্গে লিভ টুগেদার শুরু করেছি। আমরা সুখে আছি। তুমি কি খুশি নও, পাপা?’
‘লিভ টুগেদার’ শব্দ দুটো কেবলই প্রতিধ্বনিত হতে লাগল মাথার ভেতর। কানের ভেতর দিয়ে ঝাঁঝালো শব্দতরঙ্গ আঘাত হানতে লাগল ফেরদৌস আহমেদের জেনেটিক শিকড়ের মর্মতলে। তিনি যেন ডুবে যাচ্ছেন। জলবিহীন শিকড়ে ধরে গেছে আগুন। বাকশূন্য হওয়ার আগে আবার প্রশ্ন করলেন, ‘সে কি বাংলাদেশি-প্রবাসী? ব্রিটিশ-বাংলাদেশি?’
‘না, বাবা। দক্ষিণ আমেরিকান, ব্রিটিশ। ব্রিটেনের স্থায়ী সিটিজেন।’
মরিয়া হয়ে ফেরদৌস আহমেদ আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘সে কি তোমাকে বিয়ে করবে?’
‘হ্যাঁ, বাবা। ওকে নিয়ে আমি এখন অনেক সুখী। আমার আনন্দের কথা শুনে এখন মা আর তুমি খুশি নও?’
ফেরদৌস আহমেদের মনে হলো সৎ উপায়ে নিজ আয়ের রক্তধোয়া অর্থ দিয়ে খাল কেটেছেন তিনি। সেই খাল দিয়ে ভেসে যাচ্ছে মমতার নৌকা। পালতোলা নৌকা ছুটে যাচ্ছে নতুন স্রোতের টানে। ওই স্রোতে তিনি কেবলই ভাসমান খড়কুটো।