বাবর আলী

সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সম্প্রতি হেঁটে দেশের সবগুলো জেলায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন তরুণ চিকিৎসক বাবর আলী। ঢাকা ট্রিবিউনকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন এই ক্যাম্পেইনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে

প্রতিদিনই আশংকাজনকভাবে বাড়ছে পরিবেশ দূষণের মাত্রা। দূষণের অন্যতম বড় কারণ হলো প্লাস্টিক। একবার ব্যবহৃত প্লাস্টিক (সিঙ্গেল ইউজ) যত্রতত্র ফেলার কারণে উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, জলাশয় হয়ে পড়ছে আবদ্ধ। সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সম্প্রতি হেঁটে দেশের সবগুলো জেলায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন তরুণ চিকিৎসক বাবর আলী।

ঢাকা ট্রিবিউনকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন এই ক্যাম্পেইনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে-

ঢাকা ট্রিবিউন: সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে আপনি হেঁটে দেশভ্রমণ করে এলেন। এটি ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষকে কতটুকু বোঝাতে পেরেছেন? তারা কেমন সাড়া দিয়েছে?

বাবর আলী: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক কী সেটা সম্পর্কে শ্রোতাকে ছোট্ট একটা ধারণা দিয়েই আমাকে কথা বলা শুরু করতে হয়েছে। পুরো পদযাত্রায় আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, এই বিষয়টা নিয়ে যত বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। এর ক্ষতিকর দিকগুলো বিশদভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। পরিবেশগত ঝুঁকি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, সামুদ্রিক প্রাণের ঝুঁকি ইত্যাদি বিষয়ে জানানোর চেষ্টা করেছি তাদেরকে। আমার যাত্রাপথে স্কুলগুলোই ছিল মূল টার্গেট। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এই মেসেজটা পৌঁছানো আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আমি যেখানেই এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, সেখানে অনেকেই তৎক্ষণাৎ আমাকে জানিয়েছেন তারা আজ থেকেই এই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার করবেন না। অনেকেই বলেছেন তারা এর ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে আনার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন। একইভাবে যতগুলো সামাজিক সংগঠনের সাথে আমার কথা বলার সু্যোগ হয়েছে তারাও দারুণ সাড়া দিয়েছে এ ব্যাপারে। 

ঢাকা ট্রিবিউন: ৬৪ জেলাতেই পা রেখেছেন আপনি। জেলাভেদে মানুষের সচেতনতায় কোনো পার্থক্য আপনার চোখে পড়েছে? দূষণ সম্পর্কে মানুষ কতটুকু চিন্তিত? এক্ষেত্রে তরুণ ও বয়স্কদের চিন্তাধারায় কোনো পার্থক্য চোখে পড়েছে কি না?

বাবর আলী: জেলাভেদে মানুষের সচেতনতার কথা বলতে গেলে ছোট্ট একটা ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। সেদিন নেত্রকোণা থেকে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলায় যাচ্ছিলাম। পথে ঠাকুরকোণা নামে একটি বাজারে নাশতা করার সময় বছর সাত-আটেকের একটি শিশু এলো দোকান থেকে ডাল আর রুটি কিনতে। দোকানি রুটি কাগজে মুড়িয়ে দিলেও দেখলাম ওই শিশুর কাছে ডাল বিক্রি করল না। উপরন্তু বলল বাড়ি থেকে একটা বাটি নিয়ে আসতে। শিশুটি ডাল পলিথিনে নিতে চাইলেও দোকানি জানালেন, পলিথিন ব্যবহার করলে ক্রেতা-বিক্রেতা দু’জনই সম্মুখীন হবেন জরিমানার। অনেকেই হয়তো জানেন না, ময়মনসিংহ বিভাগকে পলিথিনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেখানে আপনি কোন দোকানে বাজার-সদাইয়ের পরে পলিথিন পাবেন না। এই বিভাগের লোকজন ইতোমধ্যেই পলিথিন ছাড়াই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

আর দূষণের ব্যাপারে বলতে গেলে আমার তরুণ প্রজন্মকেই অধিক সচেতন মনে হয়েছে। আমি শুধু যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক নিয়ে কথা বলেছি এমন নয়। অনেকের সাথেই আমার সামগ্রিক বর্জ্যব্যবস্থাপনা নিয়েই কথা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বা সদ্য পাস করে বের হওয়া অনেক তরুণ-তরুণীদের এই বিষয় নিয়ে ভাবনা আমাকে রীতিমতো অভিভূত করেছে।

ছবি: সৌজন্য

ঢাকা ট্রিবিউন: সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর জন্য ব্যক্তি ও সরকার পর্যায়ে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

বাবর আলী: আমি নিশ্চিত যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে যারা আছেন, তারাও এই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ভয়াবহতার বিষয়ে অবগত আছেন। তবে যেহেতু সরকারি পর্যায়ে কোনো একটা সিদ্ধান্ত আসাটা কিছুটা হলেও সময়সাপেক্ষ সেহেতু আমাদের উচিত এই মুহূর্ত থেকেই ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতন হওয়া। একটা ছোট উদাহরণ দেই। আপনি যে দোকানে নিয়মিত চা-কফি পান করেন, সেই দোকানি যদি পরিবেশনের জন্য ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করে থাকেন তবে তাকে সেটা ব্যবহার না করার অনুরোধ করতে পারেন। এতেও কাজ না হলে সেই দোকানটা এভয়েড করতে পারেন। তবে শুধু নিজে সচেতন হওয়ার মধ্যে ব্যাপারটাকে গুটিয়ে না রেখে আশেপাশের মানুষের মাঝেও ব্যাপারটা ছড়িয়ে দিতে হবে।

আরও পড়ুন- প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে পায়ে হেঁটে ৬৪ জেলা ভ্রমণ

ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেকগুলো দেশই সোচ্চার হয়েছে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে। আইন প্রণয়ন করে জেল-জরিমানারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিছু ক্ষেত্রে। তাড়াহুড়ো করে কোন প্রিম্যাচিউর সিদ্ধান্ত আসার চাইতে আমি চাইব প্রয়োগযোগ্য কোন সিদ্ধান্ত বা আইন আসুক। যে আইন শুধু সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার বা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আনবে না, নিষেধাজ্ঞা আনবে এর কাঁচামাল আমদানি, উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, বিতরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও।

২০২১ সালের মধ্যে বেশ কিছু সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। এক্ষেত্রে তাদের এপ্রোচটা অনুকরণীয় হতে পারে। তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিকল্প সমাধানগুলোর ওপর নজর রেখেই এগিয়েছেন তারা।

ঢাকা ট্রিবিউন: দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ওপর আমাদের যে এই ব্যাপক নির্ভরতা, এটা কিভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন?

বাবর আলী: এই প্রশ্নটার উত্তর সম্ভবত আমাদের সবারই জানা আছে। ব্যক্তি পর্যায়ে  বায়ো-ডিগ্রেডেবল পণ্য ব্যবহার বিষয়ক সচেতনতা বাড়লেই এটা অনেকাংশেই কমে আসবে। অনেকগুলো ক্ষেত্রেই আমরা খানিকটা সচেতন হলেই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক এড়ানো সম্ভব। প্রত্যেকটা পণ্যের জন্য আলাদা পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা বা নিতে চাওয়া বেশ কমন একটা প্র্যাকটিস। তার পরিবর্তে একটা পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ নিয়ে গেলেই আমার নিজের দ্বারা বেশ কিছু পলিথিন ব্যাগ কম ব্যবহার করা হলো। পকেটে ভারী একটা-দু’টো স্মার্টফোন নিয়ে ঘুরতে পারলে বাজারে যাওয়ার সময় এর চেয়ে অনেক হালকা ওজনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য কোনো ব্যাগ কেন আমরা নিতে পারব না?

আর তাছাড়া প্লাস্টিকের বিকল্প নিয়ে দেশে-বিদেশে বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত কাজ করেই যাচ্ছেন। কিছুদিন আগে বাংলাদেশি একজন বিজ্ঞানী সিঙ্গেল ইউজ ব্যাগ তৈরি করেছেন পাট থেকে। সেটি আবার পচনযোগ্য। এইরকম বিকল্প নিয়েই বিশ্বজুড়ে অনেকেই কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো বিকল্পটা আমরা গ্রহণ করতে পারি।

ঢাকা ট্রিবিউন: সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো না গেলে এর পুনর্ব্যবহার কতটুকু সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে?

বাবর আলী: সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোটাই এই মুহূর্তে উচিত। তবে সেটা সম্ভব না হলে পুনর্ব্যবহারই থাকে বিকল্প হিসেবে। বাংলাদেশ কিন্তু প্লাস্টিক পণ্যের পুনর্ব্যবহারে বেশ এগিয়েই আছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো কোম্পানি এই বিষয়ে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড এব্যাপারে অগ্রদূত একটি প্রতিষ্ঠান। মূলত পেট বোতল রিসাইক্লিং এর কাজ করে এ প্রতিষ্ঠানটি। এই পেট বোতলকে পুনর্চক্রায়ন করে ব্যবহারযোগ্য কাঁচামাল তৈরি করে এ প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে এ ব্যাপারে। তবে আমরা যে পরিমাণ প্লাস্টিক প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি, তার তুলনায় পুনর্চক্রায়নের হারটা কম। এক্ষেত্রে একটা অসুবিধাও আছে। আমরা ব্যবহারের পরে ঠিক জায়গায় বর্জ্য ফেলি না। ফলে এধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের প্রয়োজনীয় প্লাস্টিক দ্রব্য খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়।

আরও পড়ুন- ৬৪ জেলার মানুষকে প্লাস্টিক ব্যবহারে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এলেন বাবর

ঢাকা ট্রিবিউন: আজকাল প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে দেশের দু-এক জায়গায় ব্যক্তি উদ্যোগে গাড়ির জ্বালানি তৈরি করা হচ্ছে। এমন উদ্যোগকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

বাবর আলী: নিঃসন্দেহে দারুণ একটা ব্যাপার। এই খাতটাকে আমার দারুণ সম্ভাবনাময় বলেই মনে হয়েছে। তবে এই ধরনের উদ্যোগগুলো বেশিরভাগ সময়েই আর্থিক কারণে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্বেও মাঝপথে থমকে যায়। সেরকমটা যাতে এই উদ্যোগের ক্ষেত্রে না হয় সেটাই কামনা থাকবে।

ঢাকা ট্রিবিউন: আপনার সচেতনতা উদ্যোগের ভবিষ্যৎ কী? সামনে আর কোনো কাজ করবেন?

বাবর আলী: সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ে সচেতনতামূলক পদযাত্রা শেষ করেছি বলে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই, আমার এই বিষয়ক উদ্যোগের এখানেই পরিসমাপ্তি। এই বিষয়টা নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে বেশ কিছু পরিকল্পনা আছে আমার। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, আমার গণ্ডিও ক্ষুদ্র। তবে যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক, আমি এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করে যাব।