কূপ খনন না করেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের কাছে টাকা চায় আজারবাইজানের তেল গ্যাস কোম্পানি সকার। টাকা না দিলে বাপেক্সের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছে কোম্পানিটি। এর আগে ১০০ কোটি টাকায় একটি সম্ভাবনাময় কূপ খনন করে গ্যাস তুলতে ব্যর্থ হয় সকার। কোম্পানিটির অদক্ষতার কারণে কূপটির গ্যাস প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। নিজের দোষ ঢাকতেই দ্বিতীয় কূপের খনন কাজ না করেই টাকা চাইছে আজারবাইজানের কোম্পানিটি। নানা অজুহাতে সময় ক্ষেপণ করে তারা বাপেক্সের সঙ্গে চুক্তিও বাতিল করেছে।

২০১৭ সালের জুলাইয়ে খাগড়াছড়ির সেমুতাং দক্ষিণ-১, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ-৪ ও জামালপুরের মাদারগঞ্জ-১ এই তিনটি গ্যাস কূপ খননের জন্য সকারের সঙ্গে বাপেক্সের চুক্তি হয়। চুক্তিমূল্য ছিল ২৮০ কোটি টাকা (৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। কূপপ্রতি ৯৪ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশে কর্মরত অন্য বিদেশি কোম্পানির তুলনায় বেশ কম। কম হলেও সকারের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সংশ্নিষ্টদের।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে সেমুতাং-১ গ্যাস কূপ খনন শেষে কোনো গ্যাস পায়নি সকার। ষাটের দশকে আবিস্কৃত এই গ্যাসক্ষেত্রে এর আগে পাঁচটি কূপ খনন করা হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে গ্যাসও উত্তোলন শুরু হয়। ধারণা করা হয়, এই গ্যাসক্ষেত্রে ভালো মজুদ রয়েছে। তাই এখানে কূপ খননে গ্যাস পাওয়ার কথা। সংশ্নিষ্টদের মতে, সকারের অদক্ষতায় সম্ভাবনাময় কূপটিতে গ্যাসের প্রবাহ বন্ধ হয়েছে। অতিরিক্ত কাদা ওঠায় এবং সিমেন্টিং প্রসেসে ভুল করায় কূপ বন্ধ করে দিয়েছে সকার। তারপর বাপেক্স চুক্তি অনুসারে সকারকে শতকোটি টাকা (১১.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) প্রদান করে। অভিযোগ রয়েছে, নিজেদের টাকা পেলেও সকার খনন কাজে নিয়োগ করা বিদেশি থার্ড পার্টি কোম্পানি এবং দেশীয় ঠিকাদারদের পাওনা পরিশোধ  করেনি।

এর পর চুক্তি অনুসারে দ্বিতীয় কূপ খনন করার কথা। সেমুতাং থেকে বেগমগঞ্জ-৪-এর রিগ ও মালামাল নিয়ে কাজ শুরু করতে দেরি করে সকার। যদিও তাদের দাবি, বাপেক্সের অসহযোগিতার কারণে তারা এই কাজে এগোতে পারেনি। এর মধ্যে বেগমগঞ্জ-৪ কূপের জন্য তারা চুক্তির অতিরিক্ত ছয় মিলিয়ন ডলার দাবি করে। এ বিষয়ে বাপেক্স রাজি না করলে ২০১৮ সালে তারা চুক্তি বাতিলের পত্র দেয় এবং চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায়। এখন সকার বাপেক্সের কাছে ক্ষতিপূরণ ও বকেয়া বাবদ ১৪০ কোটি টাকা দাবি করেছে। এর মধ্যে তাদের পারফরম্যান্স গ্যারান্টি রয়েছে। এ জন্য তারা গত দেড় বছর ধরে বিভিন্নভাবে তদবির করছে। বাপেক্সের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্প্রতি আজারবাইজান সফরকালে তারা এ বিষয়ে নালিশ করে। সর্বশেষ গত ১৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে দেওয়া এক চিঠিতে তাদের বিরোধ মীমাংসা করে যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করার আহ্বান জানায় সকার। চিঠিতে তারা জানায়, এখানে বিরোধ মীমাংসা না করলে তারা আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে যাবে।

তবে বাপেক্সের কর্মকর্তাদের দাবি, চুক্তি অনুসারে দ্বিগুণ সময়ে সকার সেমুতাং কূপ খনন করে। তারা নির্ধারিত সময়ে মালামাল আনতে পারেনি। সে জন্য বাপেক্সের টপ ড্রাইভ, মালামাল ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে খনন কাজ শেষ করেছে। সংশ্নিষ্টরা আরও বলেছেন, কারিগরি দুর্বলতা, যথাযথ যন্ত্রপাতির ব্যবহারে অদক্ষতা, সঠিকভাবে আর্থিক বিশ্নেষণে ব্যর্থতা সকারকে দ্বিতীয় কূপ খননকাজ থেকে বিরত রাখে। সকার ভাড়া করে অন্য একটি কোম্পানি বাংলাদেশে এনেছিল, যা সংশ্নিষ্ট কূপ খননের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। সব মিলিয়ে তারা বাংলাদেশ ত্যাগেই নিজেদের লাভ খুঁজে পেয়েছে। এদিকে, নির্দিষ্ট সময় কাজ না করায় সকারের পারফরম্যান্স গ্যারান্টি হিসেবে ব্যাংকে রাখা প্রায় নয় কোটি টাকা তোলার উদ্যোগ নিলে কোম্পানিটি তাতে আপত্তি জানিয়েছে।

একটি সূত্র জনিয়েছে, বাপেক্সের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে কিছু ঘাটতি রয়েছে, তারই সুযোগ নিচ্ছে সকার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সমকালকে বলেন, সকার আমাদের কাছে অভিযোগ করেছে। বাপেক্সেকে বলেছি আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করতে। এ বিষয়ে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মো. আব্দুল হান্নান কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।