আজ সাতই মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে শোষণ আর অন্যায়ের বিপক্ষে মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া সেই ভাষণের মধ্যে ছিল স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। শহীদ জননী সুফিয়া কামাল ও কবি শামসুর রাহমানের ডায়েরি ও আত্মজীবনী থেকে আগুনজ্বালা এই দিনটিকে পেছন ফিরে দেখবার প্রয়াস…
বাংলাদেশের নাম পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তান ছিল। কিন্তু ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি শেখ মুজিবুর রহমান পছন্দ করতেন না বলেই এই মহান জননেতা ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের উদ্যোগ নেন। আমি বলতে লুব্ধ হচ্ছি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি একটি সহজাত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল শেখ মুজিবের। তিনি ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা তৈরি করবেন, তারপরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না।’
এখানে উল্লেখ্য, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তার গভীর অনুরাগ ছিল বলেই তিনি এই ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’ থেকে আমাদের জাতীয়সঙ্গীত নির্বাচন করেছিলেন :
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে মরি হায়, হায় রে-
ও মা অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি
… মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস বঙ্গবন্ধু বন্দি ছিলেন হানাদার পাকিস্তান সরকারের লাহোরের এক কারাগারে। বঙ্গবন্ধু নিজ চোখে কারাগারের লোহার শিক-ছাওয়া জানালা দিয়ে দেখেছেন, তার জন্য খোঁড়া হচ্ছে একটি কবর। নিজ চোখে আপন কবর তৈরি দেখা যে কতটা মর্মপীড়ক, তা শুধু ভুক্তভোগীই জানেন! শেখ মুজিবকে সেই অভিজ্ঞতার মানসিক উৎপীড়নও সইতে হয়েছে চরমে নৈঃসঙ্গ্যে।
আমাকে আবার ফিরে তাকাতে হচ্ছে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের দিকে। মনে ঝিকিয়ে উঠছে নানা দৃশ্য। কানে ভেসে আসছে কত না টুকরো কথা, মিছিলের প্রস্তুতি। বিখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসান দাঁড়িয়ে রয়েছেন- কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘কাণ্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার’ কাব্যপঙ্ক্তি-খচিত একটি ব্যানার হাতে। আমার একটি মুঠিলগ্ন সেই ব্যানারে- কামরুল হাসানের নির্দেশে। আমাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, কবি এবং প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্প লেখক মাহমুদুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং অভিনেতা হাসান ইমাম, শিশুসাহিত্যিক এখলাস্উদ্দিন আহমদ। একটি খুবই পুরোনো ছবি, আজও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মন কেমন করে, একটা বেদনাশ্রয়ী সুর মনে গুঞ্জরিত হতে থাকে।
… ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম দিকে ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’ ইত্যাদি দৃপ্ত স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে ঢাকা শহর। পরে স্ম্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’ রূপান্তরিত হলো ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্রে’। ৬ মার্চ পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল ভদ্র-শান্ত এসএম আহসানকে অপসারণ করে নতুন গভর্নর নিযুক্ত করেন জালিম ও খুনি কসাই লে. জেনারেল টিক্কা খানকে।
এদিকে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ভোরবেলা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে সাক্ষাৎ করে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনায় জানিয়ে দিলেন, ‘পূর্ব বাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।’ অবশ্য পরবর্তীকালে আমাদের জানতে ও বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়নি, যুক্তরাষ্ট্র কী বৈরী ভূমিকাই না গ্রহণ করেছিল বীর বাঙালিদের বিরুদ্ধে, তাদের জন্মভূমির বিপক্ষে! কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের জানা ছিল না, বঙ্গবন্ধু কাউকে, কোনো পরাশক্তির পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ রক্তরাঙা চোখ কিংবা ধমকে কাতর হয়ে পড়ার মতো ব্যক্তি ছিলেন না। তাই আমরা দেখি সেই একই দিন বিকেলবেলা রমনা রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে ঋজু দেহে, প্রকৃত বীরের মতো উন্নত শিরে অভূতপূর্ব, প্রদীপ্ত জনবন্যার সামনে বঙ্গবন্ধু অসাধারণ এক কবিতার মতো, বলা যেতে পারে, উচ্চারণ করলেন তাঁর ভাষণ। আদৌ লিখিত ছিল না সেই ভাষণ, টেবিলের ওপর রাখা ছিল শুধু এক টুকরো কাগজ এবং তাঁর চশমা। তিনি বজ্রকণ্ঠে বক্তৃতা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই থেমে গেল সমুদ্রের কল্লোল।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অনুপম ভঙ্গিতে শুরু করলেন-‘ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই… এর পর যদি একটা গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। … গুলি করবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। …রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- জয় বাংলা!
সেদিন আমি রমনার ময়দানে যাইনি। এই রমনার ময়দান আমার বহুদিনের চেনা, ঘোড়দৌড়, রেসুরের ভিড়, চিনাবাদাম, শবরি আম, ডালমুট, লজেন্স ইত্যাদি বিক্রেতা ও ক্রেতার ভিড় ঘেঁষে স্কুল থেকে অনেকদূর হেঁটে ইস্কাটনের বাসায় প্রায় সন্ধ্যা লাগো লাগো সময়ে ফিরতাম আমার ছোট ভাইবোনকে নিয়ে। যা হোক, বিকেলবেলা আশেক লেন থেকে দূরে একটি চায়ের দোকানে এক কাপ চা ও একটি বিস্কুট কিনে রেডিওর সামনে বসে গেলাম বেশ কৌতূহল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শোনার তীব্র আকাঙ্ক্ষায়। রমনার ময়দানে যাইনি মানুষের ভিড়ের ভয়ে। মানুষের মিছিল দেখতে এবং মিছিলে অংশ নিতে ভালো লাগে আমার; কিন্তু ভিড়ভীতি আজ অব্দি রয়ে গেছে। সত্যি কথা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত নই।