কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে আসলে হচ্ছেটা কি? আন্দোলনকারীরা কি বিভক্ত হয়ে পড়েছে? না-কি রাজনৈতিক ছাত্র নেতারা এর মধ্যে ঢুকে বিশৃঙ্খলা করছে। কেউ কেউ বলছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন এখন রাজনৈতিক রূপ নিয়েছে। সরকার বিরোধী একটা পক্ষ এটাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে? প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণার পরও কেন এই আন্দোলন? আন্দোলনকারীদের কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন। এখন পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে শিক্ষাঙ্গনগুলো।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে মন্ত্রী পরিষদ সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটিও করা হয়েছে। ওই কমিটি প্রথম বৈঠক করেছে। এর মধ্যেও আন্দোলন চলছিল। এ নিয়ে সরকারের উচ্চ মহল বিরক্ত। গতকাল সংসদে প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা পরিবর্তন করা যাবে না। এটা নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে। পাশাপাশি কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে হামলার অভিযোগে যারা গ্রেফতার হয়েছেন, আন্দোলন হলেও তাদের ছাড়া হবে না।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত ১১ এপ্রিল সংসদেই বক্তব্যে কোটা বাতিলের কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সেদিন বিরক্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, বারবার এই আন্দোলন, কোটা পদ্ধতি বাতিল করলে কি হয়, সেটা বাতিল করা হলো। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ। কোটা ‘বাতিলে’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেবে।
আন্দোলনকারী নয়, অভিযুক্তদের ধরা হচ্ছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, কোটা আন্দোলনকারী কাউকে আটক করা হচ্ছে না এবং আমরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নিচ্ছি না। শুধুমাত্র যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। যারা ভিসির বাড়ি ভাঙচুর করেছে বা অগ্নিসংযোগ করেছে তাদের ধরা হচ্ছে। এই কাজে যারা জড়িত ছিল তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। গতকাল শেরে বাংলা নগর আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজে আয়োজিত নবীনবরণ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
ঢাবির ১৪ বিভাগে ক্লাস হয়নি: আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিচার ও আটককৃতদের মুক্তির দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ডাক দেয় ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’। এই ডাকে সাড়া দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি বিভাগে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করলেও অধিকাংশ বিভাগেই স্বাভাবিক রয়েছে। ১৪টি বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন বলে জানা গেছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য তারা এই কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন বলে জানিয়েছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, আমি যতটুকু জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগেই ক্লাস হয়েছে। তবে যে বিভাগগুলোতে ক্লাস হয়নি সেসব বিভাগের শিক্ষার্থীদের বলব দাবি দাওয়া থাকলে বিভাগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে উত্থাপন করবেন। আমরা বসে সেটার সমাধান করবো।
১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি: কোটা সংস্কারের প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে ১৫ জুলাই রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপি দিবে প্রগতিশীল ছাত্র জোট। প্রচারণার অংশ হিসেবে গতকাল সন্ধা ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে তারা মশাল মিছিল বের করে। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ করে।
আন্দোলনের নেতা সুহেল গ্রেফতার: কোটা সংস্কারে আন্দোলনরত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম আহ্বায়ক এ পি এম সুহেলকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ পি এম সুহেল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার গ্রেফতারের বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন শাখার
উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, পল্টন এলাকা থেকে সুহেলকে ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। শুক্রবার তাকে আদালতে পাঠানো হবে। তবে তাকে কোন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে- সেটি এখনও জানতে পারেননি।
সূত্র জানায়, ডিবি পুলিশের একটি দল সাদা পোশাকে গতকাল সকালে রাজধানীর শান্তিনগরের চামেলীবাগের গণজাগরণের মঞ্চের নেত্রী লাকী আক্তারের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। লাকি বিষয়টি নিশ্চিত করে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে এই অভিযোগ করেন। লাকি আক্তার তার ফেসবুক ওয়ালে লেখেন, ‘আমার বাসায় ভোররাত সোয়া ৪টা নাগাদ ডিবি পুলিশ অভিযান চালায়। ৮-১০ জনের একটা দল। শুরুতে তারা বেশ উত্তেজিত ছিলেন। আমি জানতে চাইলাম- এত রাতে কোন অভিযোগে আমার বাসায় তল্ল­াশি করবেন তারা। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে তারা দরজা ভেঙে ফেলার হুমকি দেন। আমি বললাম- আপনারা সকালে আসেন। অনেকক্ষণ বাকবিতণ্ডার পর অবশেষে তারা বাড়িওয়ালা আঙ্কেলকে নিয়ে আসলে সাড়ে ৪টার দিকে আমি দরজা খুলি।’ ‘ক্যাম্পাসে আমার ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংগঠক সুহেল আমার বাসায় ছিল। তারা (সাদা পোশাকের লোকজন) তাকে তুলে নিয়ে গেছে।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে পুরো  জাতি হতাশ- নুরুল হক নুর : কোটা সংস্কার নিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্যে পুরো বাংলাদেশের মানুষ হতাশ বলে মন্তব্য করেছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর। কোটা সংস্কার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে  তিনি এই মন্তব্য করেন। নুরুল হক নুর বলেন, প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ‘কোটা বাতিল’। বিদেশ থেকে ফিরে এসে সংবাদ সম্মেলনেও বলেছিলেন, ‘সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল বাতিলই। কিন্তু এখন আবার বলা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমানো যাবে না, ৩০ শতাংশ রাখা হবে। কিছুটা রাখুক আমরাও চাই। কিন্তু ৩০ শতাংশ যেভাবে বলা হচ্ছে আমরা মনে করি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। পুরো জাতিকে হতাশ করেছে তার এই কথা। আমাদের পাঁচদফার আলোকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কোটা সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার কথাও বলেন তিনি।
ইত্তেফাক