ছবি : আরশাদ হোসেন শাহীন
হরলাল রায় সাগর, সিনিয়র রিপোর্টার: সরকারী মালিকানাধীন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)-এর লুটপাট করা ৬৪ কোটি টাকা উদ্ধারে তোড়জোড় নেই। ক্ষতিগ্রস্ত সংস্থাটির কোনো পদক্ষেপ নেই। তাকিয়ে আছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকের দিকে। আর দুদক হাঁটছে চিরাচরিত স্বভাবে-ঢিমেতালে। প্রায় ৮ বছর পর ৬জনের বিরুদ্ধে একটি চার্জশিট দাখিল করেছে আদালতে। গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে মামলার প্রধান আসামী আরশাদ হোসেন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পুলিশ ও দুদক তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। প্রভাব ও টাকার বিনিময়ে তিনি পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এবিষয়ে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী বলেন, ওই টাকা উদ্ধার বা ব্যবস্থা নিতে তাদের কিছু করার নেই। মামলার তদন্ত করছে দুদক। তারাই ব্যবস্থা নিবে।
সূত্র জানায়, ঈশ্বরদী-বাঘাবাড়ি-সিরাজগঞ্জ-বগুড়া এবং সিলেট-শাহাজিবাহার-ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ৬৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। সকলের চোখে ধুলো দিয়ে অর্থ দেখভালের দায়িত্বে থাকা কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপক (হিসাব) আরশাদ হোসেন শাহীন ২০০৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন কৌশলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। পিজিসিবি’র অভ্যন্তরীণ তদন্তে জনতা ব্যংক মহাখালী কর্পোরেট শাখার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। ব্যাংক স্টেটমেন্ট পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে দুটি প্রকল্প থেকে যে ৩৯ জনের নামে চেক ইস্যু করা হয়েছে তাদের মধ্যে ১১ জনকে শনাক্ত করাই সম্ভব হয়নি। পাঁচ ড্রাইভারের নামেও ইস্যু করা হয়েছে পাঁচ থেকে ২৯ লাখ টাকার চেক। কম্পিউটার অপারেটরের নামে ইস্যু করা হয়েছে ৯ লাখ টাকার একটি চেক। চেক ইস্যুর তালিকা থেকে বাদ পড়েনি সুইপারও। তাকেও দেয়া হয়েছে ৪ লাখ ৬২ হাজার টাকার একটি চেক।
আর্থিক অনিয়ম তদন্ত করে পিজিসিবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে প্রমাণ মিললেও অদ্যাবধি পিজিসিবি এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা সামান্য কারণ দর্শানোর নোটিসও দেয়নি। উল্টো যথাযথভাবে তদারকির অভাবে মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন ৪০৯ ধারায় অন্তর্ভুক্তির পরও আসামি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত থেকে জামিন নিয়ে বাদীকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ। পিজিসিবি সূত্র বলছে, কোম্পানির অর্থ উদ্ধারের জন্য মামলা করে বাদী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ বিষয়ে ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর শাহবাগ থানায় বাদী পিজিসিবির ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মোঃ নুরুজ্জামান হাওলাদার একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
২০১০ সালের ১৯ নভেম্বর দাখিল করা পিজিসিবির অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের পহেলা এপ্রিল এবং ১০ মে দুই দফা অডিটের পর তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মাহবুব আহমেদ এবং সাবেক প্রকল্প পরিচালক অজিত চন্দ্র দত্তকে প্রকল্পে ব্যাপকভাবে আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি জানান অডিটররা। এর পরও ২০০৯ সালের ২৩ মার্চ এবং ২০১০ সালের আগস্টে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দুটি সংশ্লিষ্ট প্রকল্প দফতরে প্রেরণ করা হয়। প্রকল্প দফতর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণতো দূরের কথা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোম্পানি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষে কাছ থেকে বিষয়টি আড়াল করে রাখে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৯ সালের মার্চে ৮২ লাখ টাকা অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে কোম্পানিকে মাত্র এক বছরের মধ্যে প্রায় ৬৪ কোটি টাকার বিরাট লোকসানের মুখোমুখি হতে হতো না। কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শুধু এই দুটি প্রকল্প নয়, পিজিসিবি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব গ্রিড লাইন নির্মাণের কাজ করেছে সেগুলোর হিসাব নিরীক্ষা করলে আরও বড় ধরনের অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যাবে।
পিজিসিবির তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভাউচারের তুলনায় অতিরিক্ত ৬৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মহাব্যবস্থাপক প্রকল্প দফতরের মাধ্যমে চার কোটি ৭৪ লাখ ২৩ হাজার ১৮৩ টাকা, ঈশ্বরদী-বাঘাবাড়ি-সিরাজগঞ্জ-বগুড়া প্রকল্প অফিসের মাধ্যমে ৫৮ কোটি ৪৭ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪৪ টাকা এবং সিলেট-শাহাজিবাজার-ব্রহ্মণবাড়িয়া প্রকল্প অফিসের মাধ্যমে ৫৩ লাখ ৭৫ হাজার ৪১ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। ব্যাংকের সকল চেকেই তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক প্রকল্পের সঙ্গে উপব্যবস্থাপক আরশাদ হোসেন স্বাক্ষর করেছেন। এক্ষেত্রে প্রকল্প দফতরের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে রুহুল আমীন (৩০-১০-০৬ থেকে ২৮-৯-০৮), মোজাম্মেল হোসেন (২৮-১০-০৮ থেকে ২৯-০৭-০৯), পি কে রায় (২৯-৭-০৯ থেকে ১৫-১১-০৯) এবং বিল্লাল হোসেন (১৬-১১-০৯ থেকে ০৬-০৯-১০) সকল চেকে স্বাক্ষর করেন। ঈশ্বরদী-বাঘাবাড়ি-সিরাজগঞ্জ-বগুড়া প্রকল্পে আরশাদ হোসেনের সঙ্গে উপ-মহাব্যবস্থাপক অজিত চন্দ্র দত্ত (৯-৭-০৭ থেকে ১৫-২-১০) এবং মাহবুব আহমেদ (১৫-২-১০ থেকে ৬-৯-১০) চেকে স্বাক্ষর করেন। এছাড়া সিলেট-শাহাজীবাজার-ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রকল্পে ৫৩ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়মের চেকে আরশাদ হোসেনের সঙ্গে মাহবুব আহমেদ যৌথ স্বাক্ষর করেছেন।
যাদের নামে চেক ইস্যু করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে দু’জন সাবেক মহাব্যবস্থাপক রয়েছেন। এঁরা হচ্ছেন- রুহুল আমীন ও মোজাম্মেল হোসেন। এছাড়া দু’জন পরিচালক (টেকনিক্যাল) ইনামুল হক ও দেলোয়ার হোসেন, পিডি (প্রকল্প পরিচালক) অজিত দত্ত, দু’জন ব্যবস্থাপক আরশাদ হোসেন ও কামরুল হোসেন। নয় সহকারী ব্যবস্থাপক বাইতুল ইসলাম, কামাল হোসেন, হুজাইফা, শহিদুল হক, এ রকিব, পলাশ দাস, মাহমুদুল হক, ইসমাইল হোসেন, গোলাম রব্বানী। দুই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম, মাজেদুল ইসলাম, কম্পিউটার অপারেটর নাসির উদ্দিন, সুইপার আবুল হোসেন, ড্রাইভার পাঁচজন সুজন হাওলাদার, শফিকুল ইসলাম, মোক্তার হোসেন, মফিজুর রহমান, মিন্টু মোল্লা। যে ১১ জনের কোন হদিস পাওয়া যায়নি কিন্তু চেকে নাম রয়েছে এরা হলেন- সুফিয়া, রোকন আলী, কামরুল ইসলাম, ফুরকান হাওলাদার, বেলায়েত ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, মোজাম্মেল হোসেন, এবিএম মাহমুদ, মোবারক, মুজিবুর রহমান।
তবে যাদের নামে চেক ইস্যু করা হয়েছে তাদের কেউ ব্যাংকে গিয়ে টাকা তোলেননি। প্রতি কর্মদিবসে প্রায় একই অঙ্কের (৮ থেকে ৯ লাখ টাকার মাঝামাঝি) তিন থেকে চারটি চেকের মাধ্যমে প্রতিদিন একই ব্যক্তি আরশাদ হোসেনকে ২৫ থেকে ৩৬ লাখ টাকা প্রদানের পরও ব্যাংক বিষয়টি কোম্পানির কাউকে ফোনে জানায়নি বা জানতে চায়নি। সূত্র বলছে, বাহকের চেকের নিয়ম অনুযায়ী চেকের উল্টোপিঠে বাহকের স্বাক্ষর থাকতে হয়। প্রায় প্রতিদিন ব্যাংকে যাওয়ায় ব্যাংকের সকলে আরশাদ হোসেনকে চেনার পরও অন্য ব্যক্তির নামের চেকে তাকে (আরশাদ) টাকা দিয়েছে।
অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবার চেক লেখার সময় আরশাদ হোসেন চেকের বাঁপাশের কিছু জায়গা খালি রেখে দ্বিতীয় স্বাক্ষরকারীর স্বাক্ষর নিয়েছেন। পরবর্তীতে ফাঁকা জায়গায় অতিরিক্ত টাকার অঙ্ক লিখে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন। এসব ক্ষেত্রে চেক লেখার সময় ত্রুটি হলে সে চেকগুলো আর ব্যবহার করা হতো না। আরশাদ হোসেন পলাতক থাকা অবস্থায় পিজিসিবি কর্তৃপক্ষ তার ড্রয়ার থেকে কাটাছেঁড়া বেশ কয়েকটি চেক উদ্ধার করেছে।
যৌথ স্বাক্ষর, ভুল তথ্য উপস্থাপন করে এক হিসাব নম্বর থেকে অন্য হিসাব নম্বরে অর্থ সরানো এবং প্রধান কার্যালয় হতে সংশ্লিষ্ট দফতরে অর্থ পাঠানোর জন্য তদন্ত কমিটি ওই ছয় কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করেছে। এছাড়া নিয়মিত হিসাব নম্বর তদারকি না করায় আরও ৪ কর্মকর্তাকে পরোক্ষভাবে দায়ী করা হয়েছে। এরা হলেন পরিচালক (অর্থ) শওকত হোসেন, মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) মোহাম্মদ সেলিম, উপমহাব্যবস্থাপক (অর্থ) বেলায়েত হোসেন, উপ-ব্যবস্থাপক (অর্থ) তানভীর আহমেদ।
প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পিজিসিবির তৎকালীন ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) নুরুজ্জামান হাওলাদার বাদী হয়ে রাজধানীর গুলশান থানায় একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে পিজিসিবির তখনকার ব্যবস্থাপক আরশাদ হোসেনকে আসামি করা হয়। ওই বছরের ২৫ নভেম্বর মামলাটিতে ৪০৯ ধারা সংযোজন করা হয়। ৮ সেপ্টেম্বও তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। আসামি আরশাদ হোসেন ওই বছরের ৭ নভেম্বর আদালত থেকে জামিন পান। অভিযোগ রয়েছে, জামিনের ক্ষেত্রে পুলিশ নিম্ন আদালতে ৪০৯ ধারা সংযোজনের বিষয়টি আড়াল করে।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, অভ্যন্তরীণ এবং বোর্ড অব ডিরেক্টরের দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়েছে। ৪০৯ ধারায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরও আসামির জামিন পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মামলার দিন ধার্য ছিল। ওই দিন আমরা ভাল আইনজীবী দিয়ে মামলাটির শুনানি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এর মধ্যে শুনলাম মূল আসামি নিম্ন আদালত থেকে জামিন পেয়ে গেছেন। জামিন নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ মামলার প্রকৃত নথি হাজির না করে কিছু তথ্য আড়াল করেছে বলে মনে করেন তিনি।
গত ১১ আগস্ট দুদক টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের অভিযুক্ত আরশাদ হোসেনসহ ৬জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছে। দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় সম্প্রতি এ চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন পিজিসিবির সাবেক মহাব্যবস্থাপক রুহুল আমিন, মোজাম্মেল হোসেন, বিল্লাল হোসেন, সাবেক উপ-মহাব্যবস্থাপক অজিত চন্দ্র দত্ত ও মাহবুব আহমেদ। এছাড়া জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আরশাদ হোসেনের বিরুদ্ধে দুদক ধানমন্ডি থানায় দুটি বিশেষ মামলা করে। গত ৩ জুন আদালতে শুনানীকালে পুলিশের সামনে থেকে আসামী আরশাদ পালিয়ে যায়। এঘটনায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এর পরের দিন আসামীর অনুপস্থিতিতে আদালত আরশাদের তিন বছরের জেল ও ৫০ লাখ টাকা জরিমানার রায় ঘোসণা করে। পরবর্তীতে আরশাদ যাতে পালিয়ে বিদেশে না যেতে পারে সেজন্য বিমান ও স্থল বন্দরগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়। কিন্তু আরশাদ নতুন নতুন গাড়িতে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে। তিনি বর্তমানে ধানমন্ডির ৪ নম্বর সড়কের পার্ক ভিউ বাড়িতে বসবাস করছেন পরিবার নিয়ে। অথচ পুলিশ ও দুদক তাকে ধরছে না। আরশাদ মোটা অংকের অর্থেও বিনিময়ে একটি প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে পুলিশ ও দুদককে ম্যানেজ করে চলছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আরশাদের বাড়ি বগুড়া শহরের সুলতানগঞ্জ পাড়ায়।