অজয় রায় ছিলেন একজন বাংলাদেশি পদার্থবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক এবং মানবাধিকার কর্মী। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন অধ্যাপক অজয় রায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ গড়ে তোলেন। সমাজে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং মানবকল্যাণবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং বিজ্ঞানকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে তিনি বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার এবং সভার আয়োজন করেছেন। বাংলাদেশের কৃষক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত করার পেছনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন অজয় রায়। আরজ আলী মাতুব্বরকে নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ বিভিন্ন সেমিনারে পঠিত হয়েছে। তাঁর পরিচালনায় প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তমনা এবং মুক্তচিন্তক লেখকদের লেখা নিয়ে সংকলিত গ্রন্থ ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’।
স্কুল এবং কলেজ জীবনে অজয় রায় পড়াশোনা করেছেন দিনাজপুরে। ১৯৫৭ সালে এমএসসি পাস করে যোগ দেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন। দেশি এবং বিদেশি বহু জার্নালে তাঁর অভিসন্দর্ভ প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যুর পূর্বাবধি তিনি বাংলা একাডেমির তিন খে ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থের সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী নৃশংস গণহত্যা শুরু করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিকভাবে কুমিল্লার সোনামুড়া বর্ডারে যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করে একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পরবর্তী সময়ে আগরতলা হয়ে কলকাতায় যান। সেখানে তিনি মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সাম্মানিক সদস্য হিসবে নিয়োজিত ছিলেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের উত্তরসূরি হিসেবে একাত্তরের মে মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন এবং বাংলাদেশ থেকে আগত শিক্ষকদের মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন অজয় রায়। অধ্যাপক অজয় রায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন এবং নিপীড়ন?রোধে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের অব্যাবহিত পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন এবং নিপীড়ন বৃদ্ধি পেলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে নিয়ে ‘নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র ব্যানারে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি মনিটরিং সেল গঠন করে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে মিলে সংখ্যালঘুদের সহায়তা করেন। ভোলার অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে নির্যাতিত নারীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন এবং দাঙ্গায় যারা গৃহ হারিয়েছিলেন, তাদের গৃহ পুনর্নির্মাণে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের সঙ্গে মিলে অধ্যাপক অজয় রায় ‘গণতদন্ত কমিশন’ তৈরি করেন, যার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ২০০২ সালে। দেশের পাহাড়ি জনগণ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনও তিনি জোরালোভাবে সমর্থন করেন।
এমন নানান সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং শিক্ষা ও জ্ঞান বিকাশে অবদানের জন্য একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলোশিপ, বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাপল্গায়েড ফিজিক্স কর্তৃক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন অধ্যাপক অজয় রায়। তার উল্লেখযোগ্য রচনাকর্মের মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞান ও দর্শন, জড়ের সন্ধানে, আদি বাঙালি : নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্নেষণ, স্বতন্ত্র ভাবনা (সম্পাদনা), চারদিক, লীলা নাগ : শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি (সম্পাদনা), বাংলা একাডেমি বিজ্ঞানকোষ (প্রথম থেকে পঞ্চম খ ) (সম্পাদনা) মুক্তান্বেষা ষাণ্মাসিক ম্যাগাজিন (সম্পাদনা), মুক্তমনা ও শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ।
বাংলার এই জ্ঞান-প্রগতির সারথি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গত বছরের ৯ ডিসেম্বর।