দাবানল

যতটুকু জানি, আগুনের কেন্দ্রে তাপমাত্রা আট’শ ডিগ্রিরও বেশি

বড় শখ করে বনের মাঝে বাড়ি কিনেছিলাম। শহর থেকে একটু দূরে, যেখানে বনের শুরু, পাশেই ছোট নদী। নিস্তব্ধ নীরবতায় সন্ধ্যা নামে, মায়াবী জ্যোৎস্না বনের নিকষ কালো অন্ধকারে হারিয়ে যায়। নিশাচর সরীসৃপের আনাগোনা, কিংবা ভুল করে পথ হারিয়ে ফেলা ক্যাঙারুর দল। রাতের নীরবতা ভেঙে প্যাঁচা প্লভার ডাক, নির্মল অনাবিল আকাশে রাতের সপ্তর্ষি মণ্ডল, বুনো ফুলের তীব্র সুবাস, দুষ্টু কাকাতুয়া কিংবা কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙা প্রতিটি সকাল।

এমনটাই চেয়েছিলাম, প্রতিটি সকাল, নতুন করে পাওয়া প্রতিটি দিন। তবে ভাগ্যদেবী বোধহয় এভাবে চায়নি। শঙ্কা উৎকণ্ঠা অনিশ্চয়তা আমার পিছু ছাড়ে না। বিপত্তি ঝঞ্ঝাট বারবার ধেয়ে আসে, নতুন রূপে, নানান বেশে, ভিন্ন সময়ে। দাবানলের কথা বলছিলাম। বনের মাঝে বাড়ি কেনার পরই বোধ হয় এর মাত্রা বেড়ে গিয়েছে, ঘনঘনই ফিরে আসছে। বনের মাঝে থাকার দায় অনেক।

আমার সঙ্কট আরও বেশি। ছেলেটা কাজ নিয়েছে চার’শ কিলোমিটার দূরে, বনের পাশে, তাসমান সাগর যেটা প্রশান্ত মহাসাগরের অবিচ্ছেদ্য অংশ তার পাড়ে, ছোট্ট শহর পোর্ট ম্যাকুয়ারীতে। সেখানে বসতি গড়েছে। আশেপাশের শহর টারি, ফস্টার আর কেম্পসির আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের আইনগত সহায়তা দেয়, আর সপ্তাহান্তে সিডনিতে, বাড়িতে ফিরে আসে। 

গত সপ্তাহে বাড়ি ফিরেই ঝামেলায় পড়েছে। পোর্ট ম্যাকুয়ারী এবং তার আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভয়াবহ দাবানল শুরু হয়েছে। আপাতত ফিরতে পারছে না, সমস্ত রাস্তাঘাট বন্ধ, অবরুদ্ধ জনপদ।

ভয়াবহ দাবানল, বিস্তীর্ণ অঞ্চল আর শত শত বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চল পুড়িয়ে অপ্রতিরোধ্য সর্বগ্রাসী আগুন এখন সিডনির দোরগোড়ায়। এদের ভাষায় “Catastrophic”, বাংলায় সম্ভবত সর্বনাশা। তারপরও মাত্র চারজনের মৃত্যু। অস্ট্রেলিয়ানরা হয়তোবা এই “মাত্র” বলাটা মেনে নেবে না। ওদের কাছে এটাই অনেক। 

দাবানলের সামনে লেখক। সৌজন্যে

এখানে দাবানল যতই বড় হোক না কেন, মানুষ মৃত্যুর হার সাধারণত খুবই কম। বিশাল দেশ, বাংলাদেশের তুলনায় ৫২ গুণ বড়। দুই’শত বছর আগে ইংল্যান্ড থেকে মাত্র কয়েক জাহাজ মানুষ, আর কিছু চোর-বদমায়েশ নিয়ে এসে দেশটা দখল করে নিয়েছে। পরবর্তীতে তাদের বংশবদরা, আর যারা ভাগ্যান্বেষণে এসেছে, বিশেষ করে ইউরোপিয়ান অভিবাসিরা, তারাই আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ানদের সম্পদ লুটে নিজেদের ভাগ্য গড়েছে। বাংলাদেশের লুটেরা ধনিক শ্রেণির সাথে তফাৎ এটুকুই, এরা আদিবাসিদের সম্পদ লুটছে, আর বাংলাদেশে লুটছে নিজ দেশি বাঙালিরাই। 

যাহোক মূল কথায় ফিরে যাই, অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা মাত্র আড়াই কোটি। পুরো দেশটাই ফাঁকা। যেখানে বৃষ্টি বাদল হয়, গাছপালা জন্মায়, বাকিটা বিরাণ লাল মাটির শুষ্কভূমি অথবা মরুভূমি। বেশি গরম পড়লে দাবানল শুরু হয়।

অস্ট্রেলিয়ানরা মূলত শহরেই বাস করে। নব্বই ভাগ মানুষ শহরে বাস করে। আর যারা গ্রামে থাকে, বনবাদাড় পরিষ্কার করে শহরের মত আধুনিক সুযোগ-সুবিধার গ্রাম তৈরি করে। এখানে কেউ রাম-সীতা কিংবা রহিম বাদশা-রূপবানের মতো বনবাসে যায় না, বা যেতে হয় না। তবে ছুটি কাটানোর জন্য অনেকেই স্বল্প সময়ের জন্য বনবাসে যায়। বুঝেশুনেই যায়, নিরাপদ মনে করলেই যায়।

বনের পাশে থাকাটা ঝুঁকিপূর্ণ এটা সত্যি, তবে আনন্দ অপরিসীম। গত বছর আমাদের পাশের বনে যখন আগুন লেগেছিলো, তিন দিনের জন্য তল্পিতল্পা গুছিয়ে পালাতে হয়েছিলো। ভাগ্যক্রমে আমাদের বাড়িঘর অক্ষত ছিলো। 

সেদিন ছিলো শনিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকালবেলাতেই ফায়ার ব্রিগেডের লোকজন এসে এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলে গেলো। বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। আমরা অপেক্ষা করছি। সকাল পেরিয়ে দুপুর, তারপর বিকেল, সন্ধ্যা, তারপরও অপেক্ষা করছি। সন্ধ্যায় আগুন বাড়ির বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে। আগুনের তীব্রতা অনুভব করছি। লেলিহান শিখা, কাছাকাছি যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এক’শ মিটার দূরেও খোলা জায়গায় থাকা যাচ্ছে না। 

যতটুকু জানি, আগুনের কেন্দ্রে তাপমাত্রা আট’শ ডিগ্রিরও বেশি। একমাত্র রাস্তা, যেটা দিয়েই শুধু আমাদের এলাকা থেকে বের হওয়া যায়, তার পূর্ব পাশটা আগুনে পুড়ছে। যেকোনো সময় গাছগুলো পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তারপরও দেখছি, অপেক্ষা করছি। ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা নিরলস চেষ্টা করছে আগুন বাগে আনতে। নাহলে রাস্তার এপারে আমাদের এলাকার বাড়িগুলো পুড়ে যাবে, আমরা দেখছি।

একটা মজার কথা মনে পড়ে গেলো। শেষ মূহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর অপেক্ষা নয়, একটা কিছু করতে হবে। সহধর্মিনী আর বাচ্চাদের কাছে জানতে চাইলাম, “রাস্তা অতিক্রম করে আগুন ধেয়ে আসলে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার পথ থাকবে না। পেছনে বন, পাশে নদীর উপর যে ছোট্ট লোহার সাঁকো আছে সেটাও আগুনের উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। তোমরা রাজি থাকলে সাঁতরিয়ে নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে পারি।” সহধর্মিনী এক কথা, “আগুনে পুড়ে মরবো, কিন্তু পানিতে নামবো না।” তার ডুবে মরতেই নাকি বেশি ভয়। কি আর করা, শেষ মূহুর্তে সাঁকো পেরিয়েই নিরাপদ আশ্রয়ে সন্ধানে যেতে হয়েছিলো। 

একটা কথা অবশ্য বলা হয়নি, বহনযোগ্য সব জরুরি জিনিসপত্র আগে থেকেই দুটো গাড়িতে ভরে, গাড়িসহ নদীর ওপারে নিরাপদ জায়গায় রেখে এসেছিলাম।

জাফিরুল হোসাইন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের সাউথ ইস্টার্ন সিডনি লোকাল হেলথ ডিস্ট্রিক্ট-এর সিনিয়র অ্যানালিস্ট

***********************************************************************************************************

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। প্রকাশিত লেখার জন্য ঢাকা ট্রিবিউন কোনও ধরনের দায় নেবে না।