অনলাইন ডেস্ক : নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়ে বন্ধ রাখা বাস চলাচল আজ সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ গতকাল রাতে সমকালকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, সারাদেশের পরিস্থিতি এখন ভালো মনে হচ্ছে। আমরা নিরাপদ মনে করছি, বাস চালানোর মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ঢাকাসহ সারাদেশে বাস চলাচল শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
মালিক সমিতির এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে চার দিন ধরে দূরপাল্লার বাস যোগাযোগে অচলাবস্থার অবসান হতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আজ থেকে ঈদের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হবে বলে সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন। এর আগে গত চার দিন ধরে গণপরিবহনে অঘোষিত ধর্মঘটের কারণে রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
গতকালও রাজধানীর চার বাস টার্মিনাল গাবতলী, সায়েদাবাদ, ফুলবাড়িয়া ও মহাখালী থেকে বাস ছাড়েনি। অন্যান্য জেলা থেকেও ঢাকায় আসেনি। পরিবহন শ্রমিকরা লাঠি হাতে মিরপুর, সায়েদাবাদে সড়কে অবস্থান নেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও অবস্থান নেন তাদের সঙ্গে। শ্রমিকরা বাস চলতে বাধা দেন। চলতে দেওয়া হয়নি রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিআরটিসির বাসও। অটোরিকশা, লেগুনা চলতেও বাধা দেওয়া হয়। আগের দিনগুলো যেখানে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছিল, গতকাল সেসব স্থানে ভোর থেকেই অবস্থান নেয় পুলিশ। ফলে শিক্ষার্থীরা সেখানে জমায়েত হতে পারেনি।
গত রোববার রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে জাবালে নূর বাসের চাপায় নিহত হন আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম নামের দুই শিক্ষার্থী। একে হত্যা আখ্যা দিয়ে বিচারসহ নয় দফা দাবিতে সারাদেশে রাজপথে নামে শিক্ষার্থীরা। গাড়ির কাগজ যাচাই ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে তারা। প্রথম দিকে তাদের আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ থাকলেও গত শনিবার জিগাতলায় তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আওয়ামী লীগ কর্মীদের। গুজবে উত্তেজিত হয়ে শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগের ধানমণ্ডি কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছিল। শনিবারের সংঘর্ষ ও গুজবে সৃষ্ট উত্তেজনার পর গতকাল শিক্ষার্থীদের সড়কে দেখা যায়নি। গাড়ি চলতে বাধা ছিল না। তার পরও সারাদেশে ছিল দুর্ভোগ। সমকালের ব্যুরো, অফিস ও প্রতিনিধিরা জানান, বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ থেকে গতকালও দূরপাল্লার কোনো রুটে বাস চলেনি। জেলা শহর থেকেও সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ ছিল। চট্টগ্রামে সকাল থেকে জেলা ও নগরের সড়কে নামেনি গণপরিবহন। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে পরিবহন শ্রমিকরা যানবাহন চলাচলে বাধা দেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ সব রুটেও বাস চলেনি। বাস না চলায় যাত্রীর ভিড় দেখা যায় খুলনায় ট্রেনে। রাজশাহীতে গতকাল থেকে রাতেও বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগের দু’দিন দিনে বন্ধ থাকলেও রাতে বাস চলাচল করেছিল। সিলেটে পরিবহন শ্রমিকরা বাস চালাতে চাইলেও বাস মালিক ও শ্রমিক নেতারা বাধা দেন। অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার সব রুটে বাস চলাচল বন্ধ ছিল বরিশালেও।
ময়মনসিংহ শহরের টাউন হল এলাকায় অবস্থান নেওয়া পরিবহন শ্রমিকরা সকালে রিকশা ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চলাচলে বাধা দেন। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় তাদের। রংপুরের কামারপাড়ায় ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে শ্রমিকদের নিয়ে বিকেলে সড়ক পরিবহন আইন ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সচেতনতামূলক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ফরিদপুর, মাদারীপুর, টাঙ্গাইল, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরা, মাগুরা, জয়পুরহাট, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট থেকে দূরপাল্লার ও অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলেনি। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, গাজীপুরের কালিয়াকৈরসহ বিভিন্ন উপজেলায়ও বাস চলাচল বন্ধ ছিল।
এদিকে উত্তরবঙ্গ ট্যাঙ্কলরি শ্রমিক ইউনিয়নও অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটের সঙ্গে গতকাল একাত্মতা ঘোষণা করে। এর ফলে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ী তেল ডিপো থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
মালিক সংগঠন সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ সমকালকে বলেছেন, রাস্তায় নামলে বাস ভেঙে দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। তাই মালিকরা বাস নামাচ্ছেন না। নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হলে মালিকরা বাস চালাবেন। কবে নাগাদ বাস চলাচল শুরু হবে, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ‘নিরাপদ’ পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বাস চলবে না।
দূরপাল্লার পথে বাস বন্ধ থাকায় রাজধানী ও বিভিন্ন জেলায় আটকা পড়েছেন অসংখ্য যাত্রী। তবে আগের দিনগুলোতে টার্মিনালে বাস ধরতে যাত্রীর ভিড় ছিল না। গতকাল গাবতলী ও মহাখালী টার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, সব বাস টার্মিনালের ভেতরে। শ্রমিকরা লাঠি হাতে রাস্তা রয়েছেন। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি আবদুল কালাম বলেন, কাউকে প্রতিহত করতে নয়, গাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিতে শ্রমিকরা রাস্তায় রয়েছে।
ঢাকার অভ্যন্তরীণ পথে বাস না থাকায় বেড়েছে অন্যান্য পরিবহনের ভাড়া। অটোরিকশায় নেওয়া হচ্ছে খেয়ালখুশি ভাড়া। গতকাল ধানমণ্ডির আট নম্বর ব্রিজ থেকে তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি পর্যন্ত ৪০০ টাকা ভাড়া হাঁকেন অটোরিকশা চালক। চালক নজরুল ইসলামের দাবি, সড়কে নিরাপত্তা নেই। যে কোনো সময় গাড়ি ভাংচুর হতে পারে। তাই বাড়তি ভাড়া নিচ্ছেন।
অ্যাপভিত্তিক পরিবহনগুলোতে ইচ্ছামাফিক ভাড়া আদায় করা হয়েছে। মোবাইলে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ‘পাঠাও’, ‘উবার’-এ চলা গাড়ি ভাড়া করা যায়নি। তবে বিভিন্ন মোড়ে ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল ছিল। যাত্রী দুর্ভোগের সুযোগ নিয়ে খেয়ালখুশিমতো ভাড়া নিয়েছে তারা। গতকাল ছিল সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস। অফিস ছুটির পর ঘরে ফেরা মানুষ যান সংকটে পড়েন। খোলা পিকআপে চড়ে গন্তব্যে পৌঁছান বহু মানুষ।