অনলাইন ডেস্ক : বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের জন্য পরম পাওয়া। সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছে আধুনিক সভ্যতার এই উপাদানটি। তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজে একটি গতি নিয়ে এসেছে। সহজ হয়েছে সমস্ত কার্যক্রম। আমাদের অনেক সময় বাঁচিয়ে আরো নতুন নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এ নব্য যুগের আবিস্কার সমূহ আমাদের জন্য অনেকাংশেই ইতিবাচক এবং আশির্বাদও বটে।

কিন্তু আমাদের যুব সমাজের একটা অংশ এ প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলোতে ঝুঁকে পড়েছে। হারাচ্ছে নীতি নৈতিকতা। বিশেষ করে কোমলমতি শিশু-কিশোরেরা এ সবের নেতিবাচক দিকগুলোর দিকে অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ে জীবনকে ধ্বংসের নিম্ন থেকে নিম্নতর স্তরে নিয়ে যাচ্ছে। যা আমাদের সমাজের জন্য অভিশাপ।

একটা সময় শিশু কিশোরদের খেলাধুলার মধ্যে ছিল মাটি ও কাপড়ের তৈরি পুতুল খেলা, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবাঁধা, বউচি, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, হাডুডু, ফুটবল প্রভৃতি খেলা। এসব খেলাধুলায় যেমন ছিল পরম আনন্দ তেমনি ছিল শরীর চর্চা ও বন্ধু বান্ধবদের সাথে সুন্দর পরিবেশে মেলামেশার মাধ্যম। খেলাধুলাগুলোর উত্তম সময় ছিল বিকেল বেলা। দুপুরের রোদ্রতাপ কমে যাওয়ার পর খেলার মাঠে শরীর চর্চা ও বিনোদন শেষে সন্ধায় বাড়ি ফিরে উৎফুল্ল মন নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে মনযোগ দিয়ে, লেখাপড়া শেষে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানো ছিল নিত্য রুটিন। বর্তমান সময়টা বদলেছে অনেক শিশু কিশোরদের পড়ার টেবিলের পাশেই থাকে ভিডিও গেমস ও কম্পিউটার। পড়তে বসলেই তাদের মাথায় ভিডিও গেমস ও ইন্টারনেটের ভূত চেপে বসে। ধনীর ঘরের ছেলেমেয়েদের তো বিনোদনের এসব উপকরণের কোন কমতি থাকা যাবেনা। অভিভাবকেরা এসব ঠুনকো আবদার শুনতে গিয়ে জীবনের শুরুতেই শিশু কিশোরদের হাতে তুলে দিচ্ছে সময় ও নৈতিকতা বিসর্জনের বড় অস্ত্র। এসব নিয়ে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডায় মেতে থাকে।

ইন্টারনেটের কল্যাণে বিদেশি অপসংস্কৃতির নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। কিশোর-কিশোরী এমনকি শিশুরাও নেশাগ্রস্তের মতো এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এর সুযোগে সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো সাইবার ক্যাফে গড়ে উঠেছে। পর্দা ঘেরা এ সমস্ত ক্যাফেগুলোতে কখনো স্কুল ফাঁকি দিয়ে কখনো পালিয়ে এরা ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবে ঘুরে ঘুরে উপভোগ করে অশ্লীল পর্ণগ্রাফী, ফেসবুকে গিয়ে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে নানা অশ্লীল ভাষায় চ্যাট করে। অধিকাংশ কিশোর-কিশোরীদের তো এখন এসব বিনোদনের ব্যবস্থা হাতের মুঠোয় হয়ে গেছে। নিম্নমান ও মূল্যের মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপে বাজার ভরে গেছে। মাত্র দশ হাজার টাকার ল্যাপটপ ও দুই হাজার টাকা মূল্যের মোবাইল ফোনেই ভিডিও ছবি তোলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যবস্থা রয়েছে। অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েদের হাতে হাতে এখন ফ্যাশন স্বরূপ ল্যাপটপ ও মোবাইল। ল্যাপটপ ও মোবাইলের মেমোরীতে অসংখ্য সিনেমা, কার্টুন, গেমস, পর্ণভিডিও, কুরূচিপূর্ণ গান ধারণ করা যায়। আর ইন্টারনেট ও ফেসবুক ব্যবহারেরও অপার সুযোগ থাকে। টিনএজার সন্তানদের হাতে হাতে মোবাইলের কারণে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হওয়াতে ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধু মুহূর্তেই একত্রিত হয়ে ধুমপান, প্রেম, ভালবাসা, ডেটিং করা, পর্নগ্রাফী দেখা, ইন্টারনেট ও ফেসবুকের মাধ্যমে খারাপ দৃশ্য ও কুরূচিপূর্ণ মন্তব্য ইত্যাদিতে সময় নষ্ট করার পাশাপাশি নানা অনৈতিক ও অসামাজিক কার্যক্রমের দিকে ধাবিত হচ্ছে। স্কুল পড়ুয়া বারো থেকে ষোল বছর বয়সী ছেলে মেয়েরাও প্রেম-ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে নির্জনে এমনকি লোকালয়ে ও রাস্তাঘাটেই তাদের অনৈতিক কাজ আর চলাফেরা হরহামেশাই চোখে পড়ে।

স্যটেলাইট মাধ্যম এখন খুবই সহজলভ্য হওয়াতে যে সময়টুকু বাসা-বাড়িতে অবস্থান করে তার অধিকাংশ সময়ই তারা ব্যস্ত থাকে বিদেশি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানমালা নিয়ে। বেশ কিছু চ্যানেলে শিক্ষনীয়, স্বাস্থ্য বিষয়ক, নৈতিকতা, ধর্মীয় ও মান সম্পন্ন রুচিশীল অনুষ্ঠানমালা প্রচার হয়। কিন্তু সেসবের পরিবর্তে আমাদের সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী অনুষ্ঠানমালার প্রতিই তরুণ প্রজন্মের ঝোঁক। শিশুরা বিভিন্ন কার্টুন চ্যানেলে প্রায় সারাক্ষণ কার্টুন দেখে সময় নষ্ট করে। বিদেশি এসব কার্টুনগুলোতে অনেক মিথ্যা কথা ও মিথ্যা অভিনয় থাকে যাতে আমাদের শিশুরা মিথ্যা কথা বলতে শেখে। হিন্দী আর ইংরেজী গান শুনে ও দেখে, আর সেসব গান এবং নাচের অনূরুপ গান গায় ও নাচ শেখে। যা শিশুদের বিদেশী ভাষা ও সংস্কৃতির দিকে আকৃষ্ট করে ধর্মীয় ও নৈতিকতা বিবর্জিত কার্যক্রমের দিকে ধাবিত করে।

স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরী এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা স্যাটেলাইটের প্রভাবে এতটাই প্রভাবিত যে, তারা এখন হিন্দী ভাষা আওড়ায় মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনার গান গায়। ভারতীয় অভিনেতা-অভিনেত্রী ঋতিক রোশন, শাহরুখ খান, কাজল কারিনাদের মতো স্টাইল করে। দেব, জিৎ, কোয়েল, শুভশ্রী, পায়েলদের মতো পোশাক পরিধান করে, তাদের পোশাক ও স্টাইল করা নিয়ে প্রতিযোগীতায় নেমে গর্ববোধ করে। বাংলা কিছু গান শুনলে ও দেখলেও তার কথা চটুল ও কুরূচিপূর্ণ।

অডিও সিডি, ভিসিডি, এমপি থ্রি, এমপি ফোর, ইউটিউব, মোবাইল ফোন এসব মাধ্যমে এখন শুধু সহজ কথার প্রেমের গান, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আদলে নির্মিত সঙ্গীতের নামে হেড়ে গলা ছেড়ে বিরক্তিকর চেঁচামেচির ব্যান্ড সঙ্গীতই তারা শুনছে।

নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, পল্লীগীতি, জারি-সারি, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, দেশাত্ববোধক এসব শিক্ষনীয় গান তো বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেঁকেলে, বিনোদনহীন ও বিরক্তিকর গান হিসেবে পরিগণিত। হামদ-নাত এ জাতীয় গানতো তাদের কাছে কেবল বৃদ্ধদের ও রমজান মাসের গান হিসেবে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে প্রচলিত এই সব বিনোদন ব্যবস্থা দেশের নতুন প্রজন্মের নৈতিক ও মানবিক গুনাবলী এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে কুঠারাঘাত করছে। টিভি পর্দা, পত্র-পত্রিকা, প্রচারপত্র, বিলবোর্ড ইত্যাদি বিজ্ঞাপন চিত্রে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী, যৌন রোগের হোমিও ও হারবাল চিকিৎসার যে সব বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে তার চিত্র ও ভাষা শিশু-কিশোরদের অল্প বয়সেই লাজ-শরম কমিয়ে অনৈতিক কাজের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দিন দিন এভাবেই অপসংস্কৃতি, অনৈতিকতা, চরিত্র বিধ্বংসী ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিরোধী কার্যক্রম বেড়েই চলছে। অত্যাধুনিক এতসব বিনোদন ও ফ্যাশানসহ অশালীন পোশাকে মেয়েরা রাস্তাঘাটে চলাফেরার কারণে প্রতিনিয়ত ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে।

এমতাবস্থায় সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার যে সব হক বা দায়িত্ব আছে তা নিষ্ঠার সাথে পালন করা ঈমানের অন্যতম দাবীর সাথে অন্যতম পারিবারিক দায়িত্বও বটে। আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (সা.) প্রদর্শিত পন্থায় সন্তানকে লালন পালনের মাধ্যমে সন্তানের প্রতি যে হক রয়েছে তা আদায় করা সকল মুসলমান নর-নারীর একান্ত কর্তব্য। সন্তানকে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি তাওহীদের শিক্ষা, কুরআন-হাদিস, আদর্শ ও নৈতিকতা এবং নামাজ শিক্ষা দেয়া ও আদায়ের অভ্যস্ত করানোর দায়িত্বও পিতা-মাতার।

ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি প্রাকিৃতিক পরিবেশ ও খোলা মাঠের খেলা-ধুলার প্রতি বেশি বেশি আগ্রহী ও উৎসাহিত করতে হবে। আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া, দ্বীনের পথে তথা কুরআন-হাদীসের পথে পরিচালনা করা, ধর্মীয় অনুশাসন পালনে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলাও অন্যতম দায়িত্ব। ইসলাম অনুমোদন করেনা এমন সব পাপ কাজ, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, পোশাক-পরিচ্ছদ, ফ্যাশান ইত্যাদি খারাপ কাজে যেন সন্তান জড়িয়ে পড়তে না পারে সে দিকে অভিভাবকদের সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে।

মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার সন্তানেরা কোন কোন কাজে ব্যবহার করছে তার প্রতি কড়া নজরদারী রাখতে হবে। বাড়ির বাহিরে এদের চলাচলের প্রতি ও সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার। জাতির জন্য দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এসব বিষয়ে সরকারের কড়া কোন নজরদারী নেই। পর্ণগ্রাফী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধের ব্যাপারে কিছু নীতিমালা থাকলেও তার যথাযথ কোন প্রয়োগ নেই। নীতিমালা প্রয়োগ কার্যে নিয়োজিতদেরই রাস্তাঘাটে এসব বিধি লঙ্ঘন করতে দেখা যায়! যার খবর পত্রিকায় অহরহ প্রকাশিত হয়।

আমাদের দেশে ইন্টারনেটে পর্নগ্রাফী ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জোড়ালো ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশু, কিশোর ও যুব সমাজকে মারাত্মক নৈতিক অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার বিষয়টি সরকারকে জরুরী ভিত্তিতে আমলে নিয়ে এদেরকে সম্পদে পরিণত করার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সুস্থ সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে অনৈতিক কার্যক্রম বড় বাঁধা। তাই এ কার্যক্রমগুলোর ব্যাপারে আইন প্রনয়ন করে অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রয়োগের নজির স্থাপন রাষ্ট্রীয় ভাবেই করতে হবে।

তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে আর্শিবাদ হিসেবে ইতিবাচক ও গঠনমূলক কাজে লাগানোর ব্যাপারে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সকলকে উৎসাহিত করতে হবে। সর্বদা মনে রাখতে হবে প্রতিটি শিশুই অনেক সম্ভাবনা এবং সৃজনশীল ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। পিতা-মাতা, অভিভাবক, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন সর্বোপরি সরকার সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অনৈতিক ও অপসাংস্কৃতিক কার্যক্রম দূর করে শিশু-কিশোর ও যুব সমাজকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর একজন আদর্শবান যোগ্য নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।

লেখক: মুহাম্মদ আব্দুল জববার
সংস্কৃতি ও মানবসম্পদ কর্মী