সামাজিক অগ্রগতির সূচকে নারীর অগ্রগতি হলেও উচ্চ আদালতে নারী বিচারপতির সংখ্যা বাড়েনি এখনও। গত দুই বছরে উচ্চ আদালতে ২৭ জন বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছে, যার মধ্যে নারী বিচারপতি রয়েছেন মাত্র দু’জন। সব মিলিয়ে উচ্চ আদালতে বর্তমানে আটজন নারী বিচারপতি কর্মরত। এর মধ্যে আপিল বিভাগে একজন এবং হাইকোর্টে সাতজন বিচারপতি রয়েছেন। এটি উচ্চ আদালতে কর্মরত মোট বিচারপতির মাত্র ৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। সুপ্রিম কোর্টে বর্তমানে নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ১০৪ জন বিচারপতি কর্মরত।

সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের আগে উচ্চ আদালতে কোনো নারী বিচারপতিই ছিলেন না। তবে এখন আটজন নারী বিচারপতি কর্মরত। তারা হলেন- আপিল বিভাগে বিচারপতি জিনাত আরা এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ, বিচারপতি কাশেফা হোসেন, বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি কাজী জিনাত হক। তারা বিভিন্ন বেঞ্চে রিট, ফৌজদারি মোশনসহ এ-সংক্রান্ত মামলার শুনানি গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করছেন। অনেক যুগান্তকারী মামলার বিচারকও তারা।

উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিচারপতি নিয়োগে আইন ও বিধিমালা না থাকায় সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দেয় সরকার। যার ফলে মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি এখনও অধরাই রয়ে গেছে। অথচ সংবিধানের ৯৫ (২) অনুচ্ছেদেই সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। আইনের মাধ্যমে যোগ্যতা নির্ধারণ করে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ করা হলে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি বিচার বিভাগে তাদের যুক্ত হওয়ার পথ সুগম হতো। কারণ অধস্তন আদালতের পরিসংখ্যান বলছে, পরীক্ষার মাধ্যমে বিচারক নিয়োগের ফলে অধস্তন আদালতে নারী বিচারকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। কর্মরত এক হাজার ৮০০ বিচারকের মধ্যে বর্তমানে ৫২০ নারী বিচারক কর্মরত, যা মোট বিচারকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।

দেশের ইতিহাসে আপিল বিভাগে প্রথম নারী বিচারপতির নাম নাজমুন আরা সুলতানা। হাইকোর্ট বিভাগ ও অধস্তন আদালতেও প্রথম নারী বিচারক তিনি। ১৯৭৫ সালের শেষের দিকে দেশের প্রথম নারী বিচারক হিসেবে যোগ দেন নাজমুন আরা সুলতানা। পরে ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি পদে নিয়োগ পান তিনি। এরপর ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতি নিযুক্ত হন তিনি। ২০১৭ সালের ৬ জুলাই তিনি অবসরে যান।

নারী বিচারকদের অগ্রযাত্রা প্রসঙ্গে বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা সমকালকে বলেন, বিচার বিভাগে ক্রমশ নারীরা এগিয়ে আসছেন। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। সুযোগ দেওয়া হলে উচ্চ আদালতেও তারা ভূমিকা রাখতে পারবেন।

নারী বিচারকদের সুবিধা-অসুবিধা, বিপদ-সংকট ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরার জন্য ১৯৮৯ সালে গঠন করা হয় বাংলাদেশ মহিলা জজ অ্যাসোসিয়েশন। এটি এখন সারা বিশ্বের নারী বিচারকদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সুপরিচিত সংগঠন।

নারী বিচারকদের অগ্রযাত্রা সম্পর্কে মহিলা জজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জ্যেষ্ঠ জেলা জজ শামীম আহাম্মদ বলেন, নারী ও পুরুষ উভয়ই বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন (বিজেএস) পরীক্ষা দিয়ে অধস্তন আদালতে বিচারক পদে নিয়োগ পান। তারা উভয়ই কিন্তু বিচার বিভাগে সমান ভূমিকা রাখছেন। যোগ্যতা ও মেধায় কেউ পিছিয়ে নন। আমরা মনে করি, উচ্চ আদালতেও বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী বিচারকদের সমানুপাতিক সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে তারা ভূমিকা রাখতে পারবেন। বিচার বিভাগে নারীদের ভূমিকা রাখার সুযোগও প্রশস্ত হবে। এতে সংবিধানে বর্ণিত নারী-পুরুষ সমান অধিকারের ভারসাম্যও সুরক্ষিত হবে।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক বলেন, বিচার বিভাগের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুযোগ পেয়ে অধস্তন আদালতে নারী বিচারকের সংখ্যা মোট বিচারকের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এটা তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার স্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু উচ্চ আদালতে তুলনামূলকভাবে এত স্বল্প নারী বিচারপতির সংখ্যা নারীদের প্রতি সরকারের বৈষম্যের প্রবণতা বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। তার মতে, অধস্তন আদালতের মতো সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের আইন হলে দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ এবং লিঙ্গ বৈষম্যের আশঙ্কা দূর হবে। এ ধরনের ব্যবস্থার কথা সংবিধানের ৯৫ (২) অনুচ্ছেদেও বলা রয়েছে, যা চার দশকেরও বেশি সময় ধরে উপেক্ষিত।