স্টাফ রিপোর্টার

সংকটে ধুঁকছে ১৪ দল। জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে শরিকদের দূরত্ব বাড়ছে। অন্য দিকে নিজেদের আগুনে পুড়ছে জোটের শরিক দলগুলোও। ভাঙা-গড়াসহ অভ্যন্তরীণ নানামুখী সমস্যায় শরিকরাও জর্জরিত, ক্ষতবিক্ষত। স্থবির হয়ে আছে তাদের নিজস্ব দলীয় কর্মকা-ও। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতির মাঠে একসময় যে আবেদন এই জোট তৈরি করেছিল, এখন তাও হারাতে বসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মূলত সরকার গঠনের পর থেকে জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগের একলা চলো নীতির কারণে শরিকদের সঙ্গে টানাপোড়েন তৈরি হতে থাকে। পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বে বাড়তে থাকে দূরত্ব। ক্রমেই তা বেড়ে চলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জোটের শরিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংকট। সরকার গঠনের পর থেকে সমসাময়িক বিষয়সহ দেশের নানা সংকটে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে সতর্ক করে আসছে ১৪ দল। কিন্তু করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারি মোকাবেলা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, খুন, গুম, ধর্ষণ, অর্থপাচার, অনিয়ম-দুর্নীতির মতো নেতিবাচক ঘটনা এবং জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন্দ্র করেও কোনো ভূমিকা নেই এই জোটের।
এ অবস্থায় ১৪ দলীয় জোটের বৈঠক ডাকার জন্য সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। জোটের প্রধান সমন্বয়ক ও মুখপাত্র, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর কাছে এই চিঠি দেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি এবং সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি। বহুল আলোচিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সংশোধনসহ সাম্প্রতিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যই মূলত তারা বৈঠকে বসার তাগিদ দেন।
বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা একটি চিঠি দিয়ে জোটের বৈঠক আয়োজনের জন্য বলেছি। আমরা মনে করি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সংশোধনসহ সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে আমাদের এক টেবিলে বসা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে জোট গঠন হয়েছিল, আজ সে অবস্থানে নেই ১৪ দল। কোনো কর্মসূচি না থাকায় জোটে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। দিন দিন সংকট বাড়ছে। আলাপ আলোচনা না হওয়ায় শরিকদের মধ্যে দূরত্বও বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া যুগান্তরকে বলেন, ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তুলে গণতন্ত্রের পথ স্বাভাবিক রাখার জন্য। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে জোট সে অবস্থানে ভূমিকা রাখছে না।
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে যে খুন, ধর্ষণ ও লুটেরা রাজনীতি চলছে, সেখানে ১৪ দল কোনো কথা বলছে না। এতে জোটের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন উঠছে। রাজনীতির মাঠে ১৪ দল একসময় যে আবেদন তৈরি করেছিল-এখন কথা না বলায় তাও তারা হারাতে বসেছে। এ অবস্থায় আমাদের একসঙ্গে বসে করণীয় ঠিক করতে হবে।’
২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। ২০০৮ সালে নির্বাচন কেন্দ্র করে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল যুক্ত হওয়ায় তা মহাজোটে রূপ নেয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন করে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে মহাজোট। যদিও এ জোট থেকে নানা সময় অনেক দল বেরিয়েছে, যুক্তও হয়েছে।
এর আগে ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে ১৪ দলীয় জোট গঠন হয়। এ সময় নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সোচ্চার ছিলেন জোটের নেতারা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ক্ষমতায় আসার পর জোটের কর্মসূচির পরিবর্তন আসে। আওয়ামী লীগের দুই আমলে শরিক দলের শীর্ষ কয়েক নেতা মন্ত্রিসভায় জায়গা পাওয়ায় জোটের কার্যক্রম থেকে সরকারের কার্যক্রমে বেশি মনোযোগী হন নেতারা। এরপর ২০১৮ সালে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রিসভায় জোটের কোনো শরিক দলের ঠাঁই মেলেনি। ফলে শরিক দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের অভিমান ও মতবিরোধ দৃশ্যমান হয়।
আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণআজাদী লীগ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি-জেপি।
এরই মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব এবং অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নামে আলাদা দল গঠন করে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ভেঙে বাংলাদেশ জাসদ নামে আলাদা দল হয়েছে। ভেঙে গেছে সাম্যবাদী দলও। গণআজাদী লীগও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে সম্প্রতি। বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন থেকে দলটির সাবেক মহাসচিব এমএ আউয়ালের নেতৃত্বে একটি অংশ বেরিয়ে গিয়ে আলাদা দল গঠন করেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, অভ্যন্তরীণ সংকট আর ভাঙা-গড়ার খেলায় ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা নিজেরাই নানাভাবে বিপর্যস্ত। দিন দিন তারা ক্ষুদ্র থেকে আরও ক্ষুদ্র হচ্ছে। শক্তি এবং সামর্থ্যও হারাচ্ছে। এ কারণে রাজনীতির মাঠে গ্রহণযোগ্যতাও কমে যাচ্ছে দলগুলোর। বিশেষ করে করোনাকালে এই মহাদুর্যোগে শরিক দলগুলোর তেমন কোনো তৎপরতাও চোখে পড়েনি। মূল দল আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এখন তাদের যাবতীয় কর্মকা-। আর এই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে শাসক দল আওয়ামী লীগও। শরিকদের দুর্বলতার কারণে তারা তাদের নানাভাবে উপেক্ষা করে যাচ্ছে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ১৩ জুন মারা যান ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম। এর ২৫ দিন পর জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র করা হয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুকে। এরপর থেকে নানা ইস্যুতে জোটগতভাবে কোনো বিবৃতি বা বক্তব্য দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় দলীয় ও ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতি দিয়ে জোট নেতারা নিজের অভিমত ব্যক্ত করছেন। কেন এই স্থবিরতা-এ বিষয়ে ভেতরে ভেতরে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
জানতে চাইলে আমির হোসেন আমু যুগান্তরকে বলেন, করোনাকালীন এই সংকটে প্রথম এবং প্রধান কাজ মানুষের জীবন রক্ষা করা। সরকার এই কাজটিই করছে। তিনি বলেন, ১৪ দল আছে, থাকবে। এটি একটি রাজনৈতিক এবং আদর্শিক জোট। করোনা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। আরও একটু উন্নতি হলেই আমরা দ্রুত বসব। আমরা আমাদের করণীয় ঠিক করব।