অনলাইন ডেস্ক : বর্জনের পথে আর হাঁটবে না বিএনপি। যেকোনো মূল্যে কিছু দাবি-দাওয়া আদায় হলে এবং নিজেরা কিছুটা ‘ছাড়’ দিয়ে হলেও আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে যাবে দলটি। দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের মতো আর ‘ভুল’ করবে না সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি। এবার সরকারকে খালি মাঠ ছেড়ে দিতে নারাজ তারা। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ‘ইঙ্গিত’ দিয়েই কারাগার থেকে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চলমান ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনের ‘সর্বাত্মক’ প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শীর্ষ নেতাদের।
গত শনিবার কারাগারে দলের তিন শীর্ষ নেতা সাক্ষাৎ করতে গেলে এসব পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। একইসঙ্গে তার মুক্তির জন্য আইনি লড়াই, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা, সব দলের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি ও সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবিতে অনড় অবস্থান ব্যক্ত করে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
ওই দিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও নজরুল ইসলাম খান। অবশ্য নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে খালেদা জিয়ার নির্দেশনা সম্পর্কে কৌশলগত কারণে তাদের কেউই প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি নন।
দলের নীতিনির্ধারক এ নেতারা জানিয়েছেন, দাবি-দাওয়া আদায়ের প্রশ্নে সরকারকে চাপের মুখে রেখে খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ অন্তত কিছু দাবি-দাওয়া আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে দলটি। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেও ভেতরে ভেতরে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের ঢাকায় কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। গোপনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশও সফর করছেন তারা।
কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারী নেতাদের সূত্রে জানা গেছে, দলের চেয়ারপারসন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া এবং সর্বাত্মক নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। একইসঙ্গে তিনি সারাদেশে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীর সাংগঠনিক তৎপরতা আরও গতিশীল করার পরামর্শ দিয়েছেন। ২০ দলীয় জোটকে আরও কার্যকর করার ও জোটের বাইরের দলগুলোকে নিয়ে পৃথক প্ল্যাটফর্ম বা পৃথক নির্বাচনী মোর্চা গঠনের পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেছেন, নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। চেয়ারপারসনকে কারাগারে রেখে তারা নির্বাচনে যাবেন না। মুক্ত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হলে নির্বাচনে যেতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক সংকটের সমাধান ছাড়া কোনো নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না। আলোচনায় বসতে হবে। দাবি মানা হলে নির্বাচনে যাবেন তারা। তবে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথাও বলেন, যেকোনো সময় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে বিএনপির। প্রতিটি আসনে ৩ থেকে ৫ জন সম্ভাব্য যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন। এখানে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য নতুন করে চেয়ারপারসনের নির্দেশনারও প্রয়োজন নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, দলের চেয়ারপারসন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চলমান আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা আরও বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে চেয়ারপারসন কোনো নিদের্শনা দিয়েছেন কি-না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে চিন্তা করার সময় এখনও আসেনি। তবে নির্বাচনের জন্য দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থীরা এমনিতেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
অবশ্য বিএনপির দাবি-দাওয়ার বিষয়গুলো আমলে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তাদের ভাষায়, সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাতে কোন দল আসবে, কোন দল আসবে না- সেটা দেখার কিছু নেই। বুধবার জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমনই বক্তব্য দেন। তিনি বলেছেন, জোর করে কাউকে নির্বাচনে আনা হবে না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে ডাক পাবে না বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংসদে থাকা দলগুলোকে নিয়ে গঠিত হবে নির্বাচনকালীন সরকার। নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানোরও পরিকল্পনা নেই সরকারের।
বিএনপির বেশ কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা জানিয়েছেন, দেশি-বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীরা যেভাবেই হোক বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। বিএনপিও সেটাই চায়। বিগত নির্বাচন বর্জন ভুল হয়েছে বলে শুভাকাঙ্ক্ষীদের বক্তব্যের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকেই একমত। নির্বাচন বর্জনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে চায় তারা।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্নেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ সমকালকে বলেছেন, জনগণ দেশে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়। সরকারকে সেই পরিবেশ অর্থাৎ ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে হবে। বিএনপিরও নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে একমত পোষণ করে দলের নেতারা মনে করেন, কিছু ছাড় দিয়ে হলেও এবার বিএনপির নির্বাচনে যাওয়াই সঙ্গত হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসন ও ভোটের মাঠে পরিস্থিতি ও পরিবেশ বদলে যাবে। তারা মনে করেন, প্রার্থীরা যদি মাঠে প্রচার চালাতে পারেন এবং ভোটাররা ভোট দিতে পারেন তাহলে ফলাফল তাদের পক্ষে আসবে। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে টানা ১০ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দলের পক্ষে জনসমর্থন কিছুটা ভাটা পড়বে বলেও মনে করেন তারা।
বিএনপি নেতারা আরও জানান, তারা খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না বললেও শেষ পর্যন্ত এ অবস্থানে নাও থাকতে পারেন। পৃথিবীর অনেক দেশে দলের প্রধান কারাগারে থেকে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তার নেতৃত্বাধীন দলও রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও নির্বাচনের পর কোনো নেতার ছেড়ে দেওয়া একটি আসনে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হতে পারবেন। এ ধরনের অনেক নজির রয়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, এসব নানা হিসাব-নিকাশ এবং দেশি-বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরামর্শ সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন কারাবন্দি খালেদা জিয়া। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েও বিগত নির্বাচন বর্জনের অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য দলীয় নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন। সূত্র জানায়, আরও আগে থেকেই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে নির্বাচনের মেনিফেস্টো তৈরি, সম্ভাব্য প্রার্থীদের ওপর একাধিক জরিপের কাজ শুরু হয়েছে। ২০ দলীয় জোটের পাশাপাশি জোটের বাইরে থাকা দলগুলোকে নিয়ে পৃথক নির্বাচনী মোর্চা গঠনেরও চেষ্টা চলছে। যার অংশ হিসেবে আজ বিএনপি সমর্থিত সুপ্রিম কোর্ট বারের নেতাদের সঙ্গে গণফোরামের চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন মতবিনিময় সভায় যোগ দিচ্ছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বোঝা গেছে, আবারও একটি নীলনকশার নির্বাচনের খেলা হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের সব পথ বন্ধ করে নির্বাচন দেওয়া হবে। এ রকম নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কেন?
রাজনৈতিক বিশ্নেষক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সমকালকে বলেন, বিএনপির উচিত হবে ভুলক্রমেও নির্বাচন বর্জনের চিন্তা না করা। জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে হবে।