ছবি: সংগৃহীত

যাওয়ার আগে অলৌকিক ক্ষমতায় মাটির সুড়ং থেকে স্বর্ণ, রৌপ্য, পিতলের থালা, কাপড়, খাদ্যশস্য, জীবন্ত ঘোড়া উগড়ে দিয়ে সেই সুড়ং ধরে গায়েব হয়ে যান ১২ জন আউলিয়া। খবর শুনে জমিদার ঘোড়ার বহর ছুটিয়ে আসেন ঘটনাস্থলে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে যতটুকু এলাকায় আউলিয়াদের পা পড়েছে, সেই জমি খাজনামুক্ত করে দেন। সুড়ঙের চারপাশে তুলে দেন প্রাচীর।

চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের আধ্যাত্মিক সাধকদের তীর্থস্থান বারো আউলিয়ার দরগাহর গোড়াপত্তনের কিংবদন্তি এভাবেই হয়েছে।

কথিত আছে বরিশালের বাকেরগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা আগা মুহাম্মদ বাকের খাঁ রাজার দেওয়া উপঢৌকন বারো আউলিয়ার কাছ থেকে ফেরত নিতে চেয়েছিলেন। 

ইতিহাস, ঐতিহ্যের অমোচনীয় সাক্ষী আর মানবকল্যাণের স্মারক হয়ে আজও টিকে আছে বারো আউলিয়ার দরগাহ বা দরবার।

জানা যায়, এ দরবারে শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আনাগোনা নয়, সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও আসেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই দরবারে মুসলমানরা আদায় করছেন নামাজ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নবান্ন উৎসব। ফলে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে বাকেরগঞ্জের বারো আউলিয়ার দরবার।

সরেজমিনে দেখা যায়, বারো আউলিয়াদের চলে যাওয়ার সেই সুড়ং মতান্তরে মাছিম শাহের কবর ঘিরে রাখা পাকুড়গাছের শিকড়ে-ডালে অসংখ্য পলিথিন এবং কাপড় বেঁধে রাখা হয়েছে। ভক্তদের বিশ্বাস, মনের আশা পলিথিনে বা কাপড়ে লিখে এই গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখলে তা পূরণ হয়। আবার আশা পূরণ হলে তা নিজ দায়িত্বে খুলে ফেলতে হয়।

বাকেরগঞ্জের বারো আউলিয়ার দরবার সিরাজ উদ্দিন আহমেদের ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘বরিশাল বিভাগের ইতিহাস’-এ সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসাবে ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত।

বারো আউলিয়ার দরবারটি ছিল মূলত আউলিয়াদের ধ্যানের জায়গা। স্থানীয় জমিদারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হলে সুড়ঙ্গ পথে নিরুদ্দেশ হন আউলিয়ারা। ভক্তরা মাজারের উত্তর পাশে সেই সুড়ঙ্গপথে দুধ ঢেলে দিত। যা কাছের একটি পুকুরে গিয়ে জমা হতো। সেই পুকুরটিকে বলা হয় দুধ পুকুর। পাকুড়গাছে আবৃত মাজারে প্রবেশের হাতের ডান দিকেই চোখে পড়বে একটি লম্বা আকৃতির কালো পাথর। পাথরের গায়ে তাজা সিঁদুর, সরিষার তেল। 

দরবারের পূর্বপাশে রয়েছে নারীদের নামাজের স্থান। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাচীন আমলে যে স্থানে মসজিদ ছিল, সেটি এখন বিলীন হয়ে গেছে। ওই আমলের একটি ঘাটলা ও দিঘির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের ধারণা, বর্তমানে যেখানে ঈদগাহ, সেখানেই ছিল মসজিদ ও ঘাটলা। যদিও এখন নতুন নকশায় আরেকটি দোতলা মসজিম নির্মাণ করা হয়েছে দরবারের মূল অংশে প্রবেশের মুখেই। 

মাজারের খাদেম ও মোতোয়ালিরা বলছেন, বারো আউলিয়ার দরবার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সব ধর্মের মানুষের প্রার্থনার জন্য উন্মুক্ত ছিল। তেমনি শত শত বছর ধরে চলে আসছে এ নিয়ম।    
  
দরবারের খাদেম আব্দুস সালাম ফকির বলেন, দরবারের মধ্যে যে মাজারটি করা হয়েছে, সেখানে আসলে কারো মরদেহ নেই। এই দরবারে বারো আউলিয়ার কেউ নেই। তারা ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন। বাদশাহর সঙ্গে দ্বিমতে তারা মাটির সুড়ং কেটে মালামাল ফেরত দিয়ে গায়েব হয়ে যান। সেই সুড়ংয়ের মুখে স্মৃতিস্বরূপ মাজার নির্মাণ করা হয়েছে।

দরবারের সেবক আব্দুল লতিফ খান বলেন, সব ধর্মের মানুষ মনের আশা পূরণে গাছের শিকড়ে পলিথিন বা কাপড় গিঁট দেয়। পূরণ হলে তা খুলে ফেলে।

মোতোয়ালির প্রতিনিধি হেলাল উদ্দিন বলেন, দরবার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন ধর্মের লোক এখানে আসেন।