ভাষা

আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখে কেউ শব্দ করে কথা বললেও আমি শুনতে পাই না। অথচ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করলেও আমি বুঝতে পারি কি বলা হচ্ছে! সুতরাং আমি বুঝতে পারতাম সাদুল্লাহর কথা। কারণ সে কথা বলতো মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে!

সাদুল্লাহ আমার ষষ্ঠ শ্রেণীতে সতীর্থ। এখন থেকে চার দশক পূর্বে। তার বাড়ি নব্বই চরে। ঝাড় কাটা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৩ মাইল পশ্চিমের ধূধূ বালুচরে। যমুনার পূর্ব তীরে। এই চর নদীর ভাঙনে দ্বিখণ্ডিত বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি থানার পূর্ব অংশ। জামালপুর জেলার (তখন মহকুমা) মাদারগঞ্জ থানার পাশে অবস্থিত।

ময়মনসিংহের নিকটবর্তী গফরগাঁওয়ের চেয়েও দুর্ধর্ষ এই এলাকা। নব্বই চরে থানা-পুলিশ যেতেও ভয় পায়। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময়ে এই এলাকা ছিল সংগ্রামী ছাত্রদের নিবিড় আশ্রয়। এই সময়ে আমার স্কুলের দশম শ্রেণীতে পড়া চাচা তার কয়েক বন্ধুকে নিয়ে নব্বই চরে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়ানোর জন্যে। গল্প শুনেছি রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় তারা সাদা জামা পরে চরের বালিতে শুয়ে থাকতেন। পুলিশের দৃষ্টি এড়ানোর জন্যে। কয়েকজন পুলিশ নাকি ছাত্রদের খোঁজে যেয়ে আর ফিরে আসেনি! বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের ভেতরে জাহাজ বা উড়োজাহাজের মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে! চিরতরে।

সাদুল্লাহ বাক প্রতিবন্ধী। তবে বোবা নয়। জন্মলগ্ন থেকেই তার ফ্যারিংস (PHARYNX) ঠিকভাবে ডেভেলপ করেনি। স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না। শুধুমাত্র হাঁসের মতন মৃদুভাবে হাঁসফাঁশ অথবা ফিসফিস করে। তার কোন কথাই মাত্র তিন গজ দূরের শ্রেণি শিক্ষকের কান পর্যন্ত কখনোই পৌঁছায় না। এমনকি হজরত আলী পর্যন্তও। হজরত আলী তার নিবিড় বন্ধু। একসাথে দুজনে নব্বই চর থেকে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে আসে। সেও তার কথা ঠিকভাবে শুনতে সমর্থ হয় না। প্রতিদিন প্রথম ক্লাসে শাহাদত স্যার পড়ান। ছাত্র-হাজিরা খাতা নিয়ে ক্লাসে আসেন। মাথা নিচু করে এক এক করে আমাদের নাম ডাকেন। সাদুল্লাহর ক্রমিক নং ২৩। আসলেই আমি প্রক্সি দেই। ‘হাজির স্যার’ বলে! স্যার কোনদিনই খেয়াল করেন না! সাদুল্লাহ মৃদু হেসে আমাকে কৃতজ্ঞতা জানায়।

সাদুল্লাহর সাথে আমার নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। হজরত আলীর সঙ্গে তার যেমন। ক্লাসমেটরা পর্যন্ত বিষয়টা নিয়ে যুগপৎভাবে বিস্মিত। আনন্দিত। তবে ঈর্ষান্বিত নয়। তারা কোনদিনই স্যারকে বলেনি যে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হবার পর গত নয়মাস থেকে আমি সাদুল্লার হাজিরা দিয়ে এসেছি। এই সময়কালে শুধু একদিন স্যার হাজিরা নেবার সময়ে মাথা তুলে তাকিয়েছিলেন। আমাকে সাদুল্লাহর স্থলে ‘হাজির স্যার’ উচ্চারন করতে দেখে ভীষণ অবাক! আমি স্যারকে বলেছিলাম, “স্যার, আমার নাম আসাদুল্লাহ হবার কারণে আমি শুনতে ভুল করে সাদুল্লাহ’র বিপরীতে হাজির উচ্চারণ করেছি।” স্যার আমাকে অবিশ্বাস করেননি। শুধু বলেছিলেন আমাকে আরও মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতে।

‘নব্বই চর’ আমার কাছে রহস্যে ঘেরা এক সিন্দাবাদের দ্বীপের নাম। যমুনার এই চরের মানুষেরা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব হতেই নব্বই চর একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো। অঘোষিত ‘মুক্ত এলাকা’। নব্বই চর থেকে দক্ষিণে অদূরে ভুয়াপুর। টাঙ্গাইলের ভেতর। আগস্ট মাসে ভুয়াপুরের কাছে যমুনা নদীতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি অস্ত্র এবং গোলাবারুদবাহী জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।আমরা সারারাত ঘুমাতে পারিনি। গোলাবারুদের মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দে। আর তীব্র আলোর ঝলকানিতে!

সাদুল্লাহ আমার চেয়ে বয়সে ৩/৪ বছরের বড়। আমিই ক্লাসের ভেতরে সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির। সুতরাং অভিভাবক ধরনের বন্ধুর প্রয়োজন আমার। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের সারথি শ্রীকৃষ্ণের মতো। আমাকে বিভিন্ন বিপদে-আপদে নিরাপত্তা দেবে। স্কুলের পার্শ্ববর্তী সরকার বাড়ীর ছেলেদের সঙ্গে আমার বিরোধ।আমার একাকীত্বকে তারা মনে করে তাদের শক্তির বৃদ্ধি। আমার পাশে সাদুল্লাহর উপস্থিতি তাদেরকে ম্রিয়মাণ করে দিলো!

সাদুল্লাহ’র সাথে আমার সখ্যতার ভিন্ন একটা কারণও আছে! রহস্যে ঘেরা নব্বই চরে আমার ভ্রমনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা। ছেলেবেলা থেকেই। আমার এক চাচাতো ভাইকে প্রস্তাব করেছিলাম ইতিপূর্বে। সে রাজী হয়নি যেতে। কারণ নব্বই চর সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনীমালা নব্বই চরকে দুর্গম পৃথিবীর অংশ করে রেখেছে। এলাকার সকল শিশুকিশোরদের ভেতরেই নব্বই চর সম্পর্কে প্রবল ভীতি!

অতঃপর শরতের এক শুভ্র সকাল। আমি আর সাদুল্লাহ নব্বই চরের প্রান্তরের ভেতরে। বিশাল জনশূন্য এলাকা। মরুভুমির মতন বালিময় প্রান্তর। দূরে যমুনার সাথে মিলেমিশে একাকার। প্রান্তরের ভেতরে কয়েকটা কুড়েঘর। বালির সমুদ্রে ভাসছে। প্রবল বাতাস। নদীর দিক থেকে। বাতাসের ভাটিতে অবস্থানরত কাউকে চিৎকার করে ডাকার দরকার হয় না। নদীর প্রবাহ আর বাতাসের গতিবেগই ফিস ফিস করে আওড়ানো শব্দমালাকে বয়ে নিয়ে যায়। প্রিয়জনদের কাছে। স্কুলে বাক প্রতিবন্ধী হিসেবে বিবেচিত সাদুল্লাহ এখানে এক উচ্ছল সবাক তরুণ!

চরের পূর্বপাশ দিগন্ত পর্যন্ত ধূসর সবুজে আচ্ছাদিত। মুগ, মসুর, ছোলা, মটর, অড়হর, মাষকলাই, খেসারির ক্ষেত। যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়। আমি আর সাদুল্লাহ ফলন্ত মটরশুঁটির লতানো শাখা প্রশাখা ছিঁড়ে আনি। শুকনো খড়ের ন্যাড়ার সাথে মিশ্রিত করে আগুন লাগিয়ে দেই। প্রবাহমান বাতাসে কয়েক মুহূর্তেই সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে চলে যায়! এন্ডারসনের রূপকথার সাদা কুয়াশার মতো। স্বচ্ছ সাদা বালির ওপরে পড়ে আছে অজস্র মটরশুঁটির ডানা। সিদ্ধ, অর্ধসিদ্ধ অথবা পোড়া। লবনের সাথে শুকনো মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে এনেছে সাদুল্লাহ। আমাদের আজকের দুপুরের লাঞ্চ!

দুপুর কাল। প্রবল বাতাস। প্রখর সূর্যকিরণ। ধূলিধূসরিত সবুজ প্রান্তর। আমি আর সাদুল্লাহ দৌড়াতে থাকি। অকারণে! দুরন্ত খরগোশের মতো। একটু দূরে সূর্যের আলো যমুনার জলে ঠিকরে পড়ছে। কয়েকটা ঘাসফড়িং লাফিয়ে লাফিয়ে উড়ছে। এক ঝাঁক সবুজ টিয়ে খুব নীচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কয়েকটা ভেড়া আর ছাগল ঘাস খাচ্ছে। এই আদিগন্ত প্রান্তরে আমাদের দুই কিশোরকে দেখার মতন আর কেউই নেই!

বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। স্কুল ছুটি দেয়া হয়েছে এক মাসের। সাদুল্লাহ আর আমি দুজনেই ক্লাস সেভেনে উঠবো। একদিন খুব সকালে হজরত আলী দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের বাড়িতে হাজির। বিগত রাতে সাদুল্লাহকে কে বা কারা মেরে কলাইয়ের ক্ষেতের ভেতরে ফেলে রেখে গেছে! লাঠি অথবা বৈঠার আঘাতে সাদুল্লাহ্’র মাথা ফেটে দুভাগ! সকাল পর্যন্ত দেহে প্রান ছিলো!

হজরতের কাছে শুনলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে সাদুল্লাহ বিড়বিড় করে অনেক কথাই বলেছে। কেউই বুঝতে পারেনি!

“একটা মৃত খরগোশ-কান্নার মতো সপ্রতিভ কোন ভাষায়
আমাকে ব্যাতিব্যাস্ত রাখে অহেতুক-আধপাওয়া ঘুমে”