ফাইল ফটো

সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা বলছেন, বহু বছরের মধ্যে তারা এতো মারাত্মক বন্যার মুখোমুখি হননি। সবমিলিয়ে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে সুনামগঞ্জের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। নেত্রকোনার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রেল যোগাযোগ।

এর পাশাপাশি রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ দেশের আরো অন্তত ১৭টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

নদী গবেষকরা বলছেন, এবারের এইরকম আকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরো কিছু উপাদান কাজ করেছে।

মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে ভারতের চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্প মেঘালয়ের পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ওপরে উঠে যায়। সেখানে ভারী হয়ে বৃষ্টি আকারে পড়তে শুরু করে।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন সূত্র বলছে, গত তিনদিন চেরাপুঞ্জিতে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে, ২৪৮৭ মিলিমিটার এবং এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম ধারাবাহিক বৃষ্টি হয়েছে ১৯৯৫ সালে একবার, তিনদিনে ২৭৯৮ মিলিমিটার আর ১৯৭৪ সালে ২৭৬০ মিলিমিটার। 

সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত থেকেই ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকার শুরু হয়েছে। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে এসে মেশে। ভৈরব বা মেঘনা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়।

কিন্তু অতীতের বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষাপট আর এখনকার নদীগুলোর অবস্থার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে বলে নদী গবেষকরা মনে করছেন। এই হঠাৎ বন্যার পেছনে চেরাপুঞ্জির এই প্রবল বৃষ্টিপাতকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন গবেষকরা।

নদীর পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া

মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। কিন্তু এবারের বন্যার পেছনে হঠাৎ উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বের হতে না পারা প্রধান কারণ বলে বলছেন গবেষকরা। আর এজন্য তারা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন।

প্রতি বছর উজান থেকে পানির সঙ্গে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি আসলে সেটা উপচে আশেপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে। 

ফাইল ফটো

ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্যতা সংকট তৈরি হচ্ছে। সেখানে গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে।

এর পাশাপাশি নদীগুলো ঠিকমতো ড্রেজিং না হওয়া, ময়লা-আবর্জনায় নদীর তলদেশ ভরে যাওয়া, ঘরবাড়ি বা নগরায়নের ফলে জলাভূমি ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন গবেষকরা।

এই কারণে মেঘালয় বা আসামে বেশি বৃষ্টিপাত হলেই সিলেট বা কুড়িগ্রাম এলাকায় বন্যার তৈরি হচ্ছে বলে গবেষকরা মনে করছেন।

অপরিকল্পিত উন্নয়ন

এবারের হঠাৎ বন্যার পেছনে মানুষের নিজেদের তৈরি কতগুলো কারণ রয়েছে। সিলেট বা সুনামগঞ্জ এলাকায় আগে ভূমি যেরকম ছিল, নদীতে নাব্যতা ছিল, এতো রাস্তাঘাট ছিল না বা স্থাপনা তৈরি হয়নি। ফলে বন্যার পানি এখন নেমে যেতেও সময় লাগে। আগে হয়তো জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারতো। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না।

হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট পকেট রোড করা হয়েছে। ফলে পানি প্রবাহে বাধার তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর গ্রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা বেশি অনুভব হচ্ছে। 

বাঁধ না থাকা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ বা নেত্রকোনা হাওর এলাকায় বেশিরভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোনো কারণে হাওরে বা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে তার খুব দ্রুত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে।

চীনসহ অনেক দেশে স্পঞ্জ সিটি তৈরি করা হচ্ছে। এসব শহরে বন্যা হলে সেই পানি শহরের ভেতরেই জমিয়ে রেখে কাজে লাগানোর পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।

কিন্তু এবার বাংলাদেশে যেভাবে আকস্মিকভাবে বৃষ্টির বা পানি বৃদ্ধির রেকর্ড ভেঙ্গে বন্যার তৈরি হয়েছে, এরকম পরিস্থিতিতে বন্যা ঠেকানো খুব কঠিন বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।