মর্মযাতনার কাহিনি

ইমিগ্রেশন বলতে বোঝায় নিজের দেশ বা জন্মস্থান ত্যাগ করে অন্যদেশে বসতি স্থাপন। ইমিগ্রেশন একুশ শতকের একটি অতি আলোচিত ও উত্তপ্ত বিষয়। ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রকৌশলিক/প্রাযুক্তিক, সাংস্কৃতিক- এরকম বিভিন্ন প্রেক্ষাপটেই ইমিগ্রেশনের গুরুত্ব অনেক। বর্তমানে পৃথিবীর এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্বল্প সময়ে অল্প খরচে যাতায়াতের সুবিধা হওয়ায় এবং ইন্টারনেটের যুগে ঘরে বসে হাতের কাছে পৃথিবীর সর্বত্র কোথায় কী ঘটে চলেছে, কোথায় কোন ধরনের শ্রম কিংবা বিশেষ শক্তির বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানব সম্পদের প্রয়োজন রয়েছে, সেসব তথ্যের প্রতুলতার কারণে ইমিগ্রেশনের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ যেমন বেড়ে গেছে, তার দৃষ্টির সামনে খুলে গেছে বহুবিধ কর্মের ও সুযোগের ক্ষেত্র। কর্মদাতা ও কর্মগ্রহীতা উভয়েই কাজের ধরন ও প্রার্থীর বাঞ্ছিত যোগ্যতা ও গুণাবলি সম্পর্কে সাক্ষাতের আগে থেকেই ওয়াকিবহাল। বর্তমানে বাছাই করার জন্য কর্মের পরিধি যেমন বেড়েছে শতগুণ, প্রার্থীর যোগ্যতার খুঁটিনাটিও আজ অনায়াসলভ্য দূর থেকেই।

তবে যেখানে খুশি, যে দেশে ইচ্ছা, সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন একদিন হয়তো তেমন কঠিন কাজ ছিল না মানুষের জন্য। তখন জনসংখ্যা কম ছিল। বহু স্থানে অকর্ষিত/অনাবাদি জমি ছিল পড়ে, যা তদারকির অভাবে পতিত বলে গণ্য হতো। কিন্তু আধুনিককালে প্রতিটি দেশ নিজেদের সীমিত সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন সম্পর্কে পূর্ণ সজাগ ও সচেতন। নিজেদের সম্পদ বা উপার্জন/অর্জন নিজেদের দেশের বর্তমান নাগরিকদের জন্যে তোলা রাখতেই পছন্দ করে বেশির ভাগ রাষ্ট্র। ফলে উন্নত দেশগুলোতে ইমিগ্রেশনের অনেক কড়াকড়ি এখন। তবে মানব সভ্যতা ও মানুষের অন্তর্নিহিত ইচ্ছা এবং বাহ্যিক কর্মাবলি প্রমাণ করে যে এইসব জুড়ে দেওয়া নকল অজুহাত ও কৃত্রিম বাধা, যেমন সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া বা কঠিন সিমেন্টের উঁচু দেয়াল নির্মাণ করা, মানুষের বহিরাগমনের পথ রুদ্ধ করতে পারেনি। দূরদেশে পাড়ি দিতে গিয়ে উত্তাল সমুদ্রে নৌকা ডুবে, প্লেনের চাকার গহ্বরে লুকিয়ে থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে গিয়ে ছত্রিশ হাজার ফুট উপরে দূর আকাশের প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমে বরফ লাশ হয়ে যাওয়া কিংবা ফ্রোজেন মাংসের বগিতে লুকিয়ে ট্রেনে করে বর্ডার পার হতে গিয়ে নিজেই জীবন্ত বরফের মাংসপিণ্ড বনে যাওয়ার অনেক গল্প আমরা শুনেছি। কিন্তু তা মানুষের বহিরাগমন রোধ করতে পারেনি। সত্যি বলতে কি, ইমিগ্রেশন নিয়ে কোনো দেশে ঢোকার ব্যাপারে যতই নিষেধাজ্ঞা বা নিরুৎসাহ বলবৎ থাকুক না কেন, আয়ের অসমতা ও জীবনযাত্রার মানের আকাশ-পাতাল পার্থক্য ইমিগ্রেশনকে এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখবে আরও অনেকদিন গ্রহীতা দেশের প্রবল বাধা সত্ত্বেও। ডমিনিকান রিপাবলিক ও হাইতি নামক দুটি দেশ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে একই দ্বীপের ভেতর অবস্থিত। পাশাপাশি। এমনটি সাধারণত দেখা যায় না। এক একটি দ্বীপ প্রায় সর্বত্রই এক একটি ভিন্ন দেশ বা রাষ্ট্র বলে পরিচিত হয়। কখনও বা কয়েকটি দ্বীপের সমাহারে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়, যে সব দ্বীপের পাশাপাশি অবস্থান এবং ভৌগোলিক, সামাজিক সাদৃশ্য একটি দেশের অবয়ব দিতে বাধার সৃষ্টি করে না, যেমন ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু একই দ্বীপে মোটামুটি ধনী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিক ও পৃথিবীর অন্যতম অতি দরিদ্র দেশ হাইতির অবস্থানের কারণে শত বাধা ও দুই দেশের মাঝখানে তীব্র ক্ষরস্রোতা নদী থাকা সত্ত্বেও হাইতি থেকে ডমিনিকান রিপাবলিকে নিরন্তর মানুষের মাইগ্রেশন হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও। প্রধানত রোজগার করতে, জীবিকার খোঁজে দেশান্তরে যায় এসব লোক। প্রায় সকলেই তারা ডমিনিকার অর্থকরী ফসল আখের চাষ করতে আসে। পর্যটন ছাড়া আখ থেকে তৈরি চিনি রপ্তানিই ডমিনিকার প্রধান আয়ের উৎস। এডুইজ ডান্টিকাটের (Edwidge Danticat) বিখ্যাত উপন্যাস  Farming of Bones পাশাপাশি অবস্থিত এই দুই দেশের ভেতর অর্থনৈতিক ও সামাজিক টানাপোড়েনের বাস্তব কাহিনি। হাইতিতে জন্ম আমেরিকান তরুণী লেখক এডুইজ ডান্টিকাট খুব মর্মস্পর্শী ভাষায় হাইতির এই ট্র্যাজেডি বর্ণনা করেছেন।

ইমিগ্রেশনের সমার্থক বা প্রায় কাছাকাছি ব্যবহূত শব্দ 

ইমিগ্রেশন শব্দটার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বা এর বিকল্প হিসেবে প্রতিনিয়ত ব্যবহার হছে আরও কিছু শব্দ- বিশেষ্য ও বিশেষণ দুটোই। যেমন- অভিবাসন, দেশান্তর, পরবাস, নির্বাসন, প্রবাস, অনাবাস, ভিনদেশ, দেশত্যাগ, বহিরাগত, ডায়েস্পোরা, বিদেশবাস, উদ্বাসন, শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী, অন্যবাস, অভিবাসী, অনাবাসী, বিদেশ, প্রবাসী, পরবাসী, বিদেশি, বিদেশবাসী, অভিবাস।

ইমিগ্রেশন ও মাইগ্রেশন; ইমিগ্রেশন ও মাইগ্রেশন শব্দ দুটো মূলত মানুষের জন্মস্থান বা পরিচিত জায়গা বা দেশত্যাগ করে অন্য এক স্থানে চলে গিয়ে নতুন করে বসতি গড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও মাইগ্রেশন বলতে আমরা কেবল কোনো জায়গা থেকে লোকজনের চলে যাওয়ার কথাই বুঝি। ইমিগ্রেশন বলতে অন্য স্থানে বসতি গড়ার বা গড়তে দেওয়ার অধিকারপ্রাপ্তির (যেমন নয়া স্থানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য বৈধ ভিসা) কথা বুঝি। মাইগ্রেশন শব্দটি সাধারণত পরিচিত জায়গা ছেড়ে মানুষের স্থায়ীভাবে অন্য অঞ্চলে চলে যাওয়া বোঝায়। ব্যক্তিবিশেষের অন্যত্র চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে মাইগ্রেশন শব্দটি তেমন ব্যবহার হয় না। মাইগ্রেশন বলতে আমরা সাধারণত এক বিশাল জনস্রোত বা জনগোষ্ঠীর বিশেষ কোনো জায়গা থেকে চলে যাওয়া বুঝি। অন্যদিকে ইমিগ্রেশন বলতে দলবদ্ধ মানুষের চেয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে নতুন কোনো স্থানে বসতি গড়ার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হতে দেখা যায়। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি থেকে বহু ইহুদি ঘরবাড়ি ছেড়ে কেবল জীবন নিয়ে মাইগ্রেশন করে পৃথিবীর নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। তার ভেতর ছিলেন জার্মান উঠতি লেখক (কবি) নেলী স্যাক্স (Nelly Sachs), যিনি পরে তাঁর ফেলে যাওয়া দেশ নিয়ে ডায়াস্পোরিক কবিতা লিখে নোবেল পুরস্কার পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে যখন নেলী স্যাক্সসহ তাদের গোটা ইহুদি পরিবার গভীর সংকটের মুখোমুখি, তখন সুইডেনের আরেক বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী নারী সেলমা লগারলফের মধ্যস্থতায় ইমিগ্রেশন নিয়ে নেলী স্যাক্স ও তাঁর পরিবার সুইডেন চলে আসেন। নেলী সেলমা লগারলফের পূর্বপরিচিতা ছিলেন। চিঠিপত্রে এই দুই অসম বয়সী সৃজনশীল নারীর এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। যার ওপর ভিত্তি করে এবং যার সাহায্যে নেলী সুইডেনে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

ইমিগ্রেশনের সার্বিক পরিণাম :গবেষণায় দেখা গেছে যে ইমিগ্রেশন সাধারণত সকল পক্ষের মানুষের জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে। যে দেশ থেকে লোকেরা চলে যায় সে দেশ ও জনগণ যেমন লাভবান হয় (বিশেষ করে বৈদেশিক রেমিট্যান্স পাওয়ার মাধ্যমে), যে দেশে ইমিগ্রেশন গ্রহণ করা হয় সেই দেশও লাভবান হয় একজন পূর্ণ শিক্ষিত, অভিজ্ঞ প্রফেশনালকে বিনা খরচে একেবারে তৈরি অবস্থায় দেশের কাজে সরাসরি লাগাতে পারে বলে। আর যে ব্যক্তি ইমিগ্রেশন নিয়ে যান বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি উন্নততর অর্থনৈতিক জীবনের আস্বাদ পান বলেই যান এবং সেজন্যই সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যদি ইমিগ্রেশনের নানা প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলা যায়, তাহলে শুভর আগমন ঘটে সর্বত্র। ইমিগ্রেশনের জটিলতা কমালে দেশের জিডিপি বাড়ে। গবেষণা এটাও দেখিয়েছে যে উন্নত ও অনুন্নত দেশের ভেতর শ্রমিক ইমিগ্রেশনের সকল বাধা, প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলতে পারলে জগৎজুড়ে দারিদ্র্য মোচন করা সহজতর হবে।

ঘরমুখী মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই প্রাণী মাত্রই সচল। তারা এক জায়গায় বাঁধা থাকে না। প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ায়। উন্নততর জীবন ও খাদ্য, নিরাপত্তা এবং বাসস্থানের নিশ্চয়তার জন্য মানুষ স্থানান্তরে চলে যায়। শুধু কি মানুষ? প্রাণী মাত্রই তা করে। গৃহপালিত গরু, বিড়াল ও কুকুরের কথা আমরা জানি। বহুদূরে অপরিচিত জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দিলেও তারা অধিকাংশই নিজ বাড়িতে একা একাই ফিরে আসতে সমর্থ হয়। সেটা স্বস্থান বা পরিচিত জায়গার টানে না প্রভুর প্রতি আনুগত্য বা নির্ভরতায় তা বলা যায় না। স্যামন মাছের কথা আমরা সকলেই জানি, স্যামনের জন্ম নদীর মিঠা জলে। জন্মের পর তারা চলে যায় মহাসাগরে- প্রধানত প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল নোনা জলরাশিতে। বছর পাঁচেক পরে শরীরে যৌবন আসতে শুরু করলে আরম্ভ হয় তাদের উল্টোযাত্রা- একমুখী এ যাত্রা মানে ঘরে ফেরার জন্য দুরন্ত ছোটা। শত শত, এমনকি হাজার হাজার মাইল দূর থেকে সাঁতরাতে সাঁতরাতে ফিরে আসে তারা ঠিক জন্মনদীতে। ফেরার পথে কত ভয়, সংকট। কত বাধা, বিপত্তি, ঝুঁকি। মানুষের হাতে, জলের অন্যান্য প্রাণীর কাছে যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যু ঘটতে পারে। ঘটেও। সাঁতরে সাঁতরে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে কত স্যামন আপনাআপনি মারা যায় পথেই। তবু তারা ফিরে আসতে চায় নিজ জন্মজলে। ফিরে এসে নিজের ঘরে সন্তান জন্ম দিয়ে অর্থাৎ ডিম পেড়ে তারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। ইলিশ মাছের জীবন কাহিনিও প্রায় একই রকম শোনা যায়। মাইগ্রেটরি বা অতিথি পাখির কথাও আমরা শুনেছি। জানি, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পথে দল বেঁধে উড়ে চলে তারা। শত শত, এমনকি হাজার হাজার মাইলের সমুদ্র বা মহাশূন্য অতিক্রম করে দূরদূরান্তের গন্তব্যের লক্ষ্যে তারা ছোটে। তাদের পথ এবং যাত্রার সময় এমন সুনির্দিষ্ট থাকে যে পাখি পরিদ্রষ্টারা আগে থেকেই সেই সব স্থানে অবস্থান নিয়ে অতিথি পাখিদের স্বাগত জানাতে পারে। জলবায়ু, তাপমাত্রা বা আবহাওয়ার অন্য কোনোরকম নেতিবাচক বা মারাত্মক পরিবর্তন হলে তারা যাত্রা বিলম্বিত করে অথবা পথ/গন্তব্য পাল্টায়। সেজন্য পাখির বিশাল কোনো দল একত্রে উড়ে এসে নতুন কোনো জায়গায় বিচরণ করার আগে তারা কয়েকটি পর্যবেক্ষক পাখিকে গন্তব্যের নিরাপত্তা ও সঠিক অবস্থা যাচাই করতে আগে পাঠিয়ে দেয়। এদিকে যেসব পাখি উড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে গন্তব্যে যেতে অভ্যস্ত, তারা যাত্রা-পূর্বকালে অনেক দিন ধরে ঘরে বসে বসে বেশি করে খেয়েদেয়ে শরীরে প্রচুর চর্বি জমিয়ে নিজেদের ওজনের কয়েকগুণ বেশি ভারী ও গোলগাল হয়ে ওঠে, যাতে না থেমে বহুদূর পর্যন্ত উড়ে যেতে বাইরের কিছু না খেয়েও নিজের শরীরের চর্বি ভাঙিয়ে চলতে পারে।

আন্তর্জাতিক দেশান্তর ছাড়াও স্থানান্তর বা অন্য স্থানে গমন দেশের ভেতরেও ঘটে থাকে। যেমন, বাংলাদেশে গ্রাম থেকে শহরে অনবরত স্থানান্তর, গৃহযুদ্ধের পর আমেরিকায় একদা ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহূত কৃষ্ণকায় লোকদের যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ উপকূলের অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর দিকের অপেক্ষাকৃত উন্নত ও শিল্পপ্রধান অঙ্গরাজ্যগুলোতে পাঠানো হয়। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতিতে উৎসাহ দিতে রাবার চাষে তাদের বহুরকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হতো। পূর্ব কানাডার উন্নত অঞ্চল বা নামকরা শহর ছেড়ে কোনো নাগরিক বা ইমিগ্র্যান্ট যদি পশ্চিমের অনুন্নত ও বিরল জনসংখ্যার প্রদেশে যেতে রাজি থাকে, তাদের অনেক রকম বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কানাডায় নতুন ইমিগ্র্যান্টদের বেলায় বাড়তি কয়েকজন আত্মীয়কে সঙ্গে ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে আনতে দেওয়া হয় সেসব বিরল জনসংখ্যার প্রদেশে যেতে রাজি হলে। এসব অতিরিক্ত সুবিধার জন্য অনেকে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে দেখা যায় মানুষের স্থানান্তর বা নিজ জন্মভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়া দেশের ভেতর আভ্যন্তরীণ হতে পারে বা আন্তর্জাতিক হতে পারে।

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক অভিবাসন

১. আমেরিকায় দাসপ্রথা (১৬৬৯-১৮৬৩) আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস ক্রয় :১৬১৯ সালে ডাচরা সর্বপ্রথম আফ্রিকান কালো মানুষদের খাঁচায় বন্দি করে আমেরিকায় নিয়ে আসে। তখন থেকে আমেরিকানদের পরিচয় ঘটে মানুষ বেচাকেনার প্রথা বা দাসপ্রথার সঙ্গে। দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোতে তুলা চাষে এই দাসদাসীদের শ্রম ব্যবহূত হতো। প্রচুর নির্দোষ আফ্রিকান দাসদাসী তাদের অনিচ্ছায় বা অজান্তে বিক্রীত হতো ধনী আমেরিকানদের কাছে নানা ধরনের অত্যাচার সইবার জন্য ও দাসীবৃত্তি করার জন্য। ১৮৬৩ সালে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে আব্রাহাম লিঙ্কন দাসপ্রথা অবলুপ্ত করেন এবং ক্রীতদাসদের মুক্ত করেন।

২. ইংরেজ উপনিবেশকালে বহু ভারতীয়কে আখ চাষের জন্য দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ১৩টি দেশে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপকূল অঞ্চলে, যেখানে ব্রিটিশদের ঘাঁটি ছিল সেখানে পাঠানো হয়েছে তাদের ইচ্ছার তোয়াক্কা না করেই। এসব ভারতীয়কে পাঠানো হয় মূলত শ্রমিক হিসেবে। ক্রীতদাস প্রথা নির্মূল হওয়ার পর সেসব দেশে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছিল। এছাড়া আফ্রিকার কিছু ব্রিটিশ আওতাধীন দেশেও ভারতীয়দের পাঠানো হয়, যেমন মরিশাস, দক্ষিণ আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকার কয়েকটি দেশে। সেটা ছিল বড় রকমের দেশত্যাগ। এবং এই mass migration-এর বেশির ভাগই অনিচ্ছাকৃত।

৩. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৬-৪২) :দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিসহ ইউরোপের, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের ইহুদিদের মেরেকেটে দেশত্যাগে বাধ্য করে হিটলারের নাৎসি বাহিনী।

৪. ভারত ভাগ ১৯৪৭ :মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দেশত্যাগ। ২০ মিলিয়ন হিন্দু, মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে গিয়ে বসতি গড়ে ভারত ভাগের ফলে। এছাড়া এক মিলিয়ন লোক দাঙ্গায় খুন হয়। ১৫ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়। ১৯৪৭ সালে একটি দেশ (ভারতবর্ষ) ভেঙে প্রথমে দুটি হয়- ভারত ও পাকিস্তান। পরে, ১৯৭১ সালে, অপেক্ষাকৃত ছোট দেশটি (পাকিস্তান) পুনরায় ভাঙে এবং জন্ম হয় আরও একটি স্বাধীন দেশের (বাংলাদেশ)। তা সত্ত্বেও যে ধর্মীয় সমস্যা সমাধানের নামে এই প্রথম দেশভাগ হয়েছিল সে সমস্যার সমাধান আজও হয়নি। তিন দেশেই সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় রয়ে গেছে। আজও দেশত্যাগ চলছে। মানবতা কেঁদে ফিরছে। মাঝে মাঝে হয় ধর্মীয় সংঘর্ষ।

৫. ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ :বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হন প্রায় এক কোটি শরণার্থী বাংলাদেশি, যারা অবশ্য বছর ঘোরার আগেই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তবে যারা শরণার্থী হিসেবে গিয়েছিলেন, প্রায় সকলে ফিরে এলেও কিছু কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোক স্থায়ীভাবে ভারতে থেকে গেছেন স্বেচ্ছায়।

৬. ১৮৬০-১৯৭১ এই ১১০ বছরে ইতালির নাগরিকরা স্বেচ্ছায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণে কোনো একটি দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যায়। এই স্বেচ্ছায় দেশত্যাগী ইতালিয়ানের সংখ্যা ১৩ মিলিয়ন।

৭. ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাশ (Gold Rush ১৮৪৯-১৮৫৫) :জেমস মার্শাল বলে এক লোক ১৮৪৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার এক নদীতে বিস্তর পরিমাণ স্বর্ণ আবিস্কার করলে আমেরিকার অন্যান্য অঙ্গরাজ্য ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ ছোটে ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে স্বর্ণের খোঁজে। গোল্ড রাশের আগে ক্যালিফোর্নিয়ার জনসংখ্যা (নেটিভ ইন্ডিয়ান ব্যতীত) মাত্র হাজার দুয়েক থাকলেও ভাগ্যান্বেষী বহিরাগতদের আগমনে এক বছরের ভেতর (১৮৫০ সালে) এ জনসংখ্যা ২০ হাজারে উন্নীত হয়। আর ১৮৫৩ সালে কালিফোর্নিয়ার জনসংখ্যা ৩০০,০০০-এ উঠে আসে। তার মানে সমস্ত পৃথিবী থেকে প্রায় ৩০০,০০০ লোক ছুটে আসে ক্যালিফোর্নিয়ায় কেবল স্বর্ণের খোঁজে। এর মধ্যে অনেকেই বাড়িঘর বিক্রি করে বা বন্ধক রেখে, ধার করে, সর্বস্ব খুইয়ে ভাগ্য পরীক্ষায় ক্যালিফোর্নিয়র দিকে রওনা হন। কেউ স্থলপথে, কেউ জলপথে। এই গোল্ড রাশের পরেই যুক্তরাষ্ট্র ক্যালিফোর্নিয়াকে তার দেশের একটি রাজ্য হিসেবে নিয়ে নেয়। গোল্ড রাশে বিপুল পরিমাণ মানুষের মাইগ্রেশন মানব ইতিহাসে অন্যতম বিশাল স্থানান্তর বলে পরিচিত। এই গোল্ড রাশে কিছু লোক স্বর্ণ পেয়ে ধনী হলেও অধিকাংশ মানুষ সব খুইয়ে, প্রচুর সময় ও শ্রম ক্ষয় করে একেবারে নিঃস্ব ও হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু বহু সময় ব্যয় করে স্বর্ণ বা স্বর্ণের খনি খুঁজে না পেলেও ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আকর্ষণীয় আবহাওয়া অনেকেরই ভালো লেগে যায় এবং তারা সেখানেই থেকে যান।

স্থানান্তর বা দেশত্যাগ ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত উভয়ই হতে পারে।

ইচ্ছাকৃত ইমিগ্রেশন

১. উন্নততর জীবনের আকাঙ্ক্ষা;

২. জীবিকার প্রতুলতা/রোজগার/বেতনের তারতম্য;

৩. ধর্ম, দর্শন, মত, বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য নিজ দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হওয়া;

৪. জীবনযাপনে ও মতপ্রকাশে স্বাধীনতার অভাব ও নিরাপত্তাহীনতা; যেমন কোনো কোনো দেশে সমকামী লোকজন, নাস্তিক গোষ্ঠী অথবা নারীর চলাফেরা, পোশাক-আশাকের ধরন সমাজ মেনে নিতে অসমর্থ হলে তারাও অস্বস্তিতে দেশ ছাড়ে।

৫. পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য- দুই দেশের নারী-পুরুষের মধ্যে বিবাহের মাধ্যমে অথবা কোনো অভিবাসী পারিবারিক সদস্য যখন স্বদেশে বসবাসরত অন্য পারিবারিক সদস্যদের প্রবাসে নিয়ে যান;

৬. কুসংস্কার এড়াতে বা কুসংস্কারের হাত থেকে বাঁচতে;

৭. জীবিকা, সম্পদ ও জায়গাজমিনের মালিকানায় ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম না হলে, অথবা ন্যায়বিচার না পেলে;

৮. পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উঁচুমানের লেখাপড়ার সুযোগ ও উন্নতমানের জীবনের প্রত্যাশায়।

অনিচ্ছাকৃত ইমিগ্রেশন

১. নির্বাসন- মতাদর্শে গরমিল আবিস্কার করলে, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী উৎখাতের আকাঙ্ক্ষায়। কিংবা তাযীর-এর শাস্তির পরিণামে। ইসলাম অপরাধ প্রতিরোধের জন্য কিছু শাস্তির বিধান নির্ধারণ করেছে। যেসকল শাস্তির জন্য কোনো দণ্ডবিধি রাখেনি তার আওতায় শাস্তি প্রদান করাকে তাযীর বলা হয়। তাযীর-এর শাস্তি কার্যকর হতে পারে উপদেশ প্রদান, ভীতি প্রদর্শন, আটক রাখা, কাউকে একঘরে করে রাখা, বেত্রাঘাত করা অথবা নির্বাসনে পাঠানোর মধ্য দিয়ে; সরকারের মতানুসারে কাজ না করলে কাউকে কাউকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সে ক্ষেত্রেও অন্য কোনো দেশের তার দায়িত্ব নেওয়ার অঙ্গীকার করতে হয়।

২. জোর করে শ্রম পাচার;

৩. ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক পরিবর্তনে দেশের সীমারেখার পরিবর্তন বা বিভক্তি;

৪. যুদ্ধ, মহামারি, মন্বন্তর, খরা, বন্যা, জলবায়ুর তারতম্য, তাপমাত্রার পরিবর্তন;

৫. রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কারের কারণে ভিন্নতার প্রতি বৈষম্য, তাচ্ছিল্য ও বৈরী আচরণ প্রয়োগ করে দেশত্যাগে বাধ্য করা।

৬. সম্পদ, জায়গাজমিনের মালিকানায় ন্যায়সঙ্গত অধিকার হরণ করে ক্ষমতাহীনদের নিজ মাটি থেকে বিতাড়ন।

ইমিগ্রেশন বিষয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান :২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশনের সংখ্যা বেড়ে ২৪৪ মিলিয়নে ঠেকে, যা ২০০০ সালের তুলনায় ৪১% বেশি। এই আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশনে মানুষ প্রধানত ২০টি দেশে বসতি স্থাপন করতে যায়। মোট ইমিগ্র্যান্টদের মধ্যে এশিয়া থেকে যায় প্রায় অর্ধেক, ইউরোপ থেকে এক-চতুর্থাংশ। পৃথিবীর সকল দেশের মধ্য সবচেয়ে বেশি যে দেশের লোক অভিবাসন গ্রহণ করে সেটা হলো ভারত (১৬ মিলিয়ন)। এর পরের অন্য দুটি দেশ যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোক ডায়াস্পোরা হয় তারা হলো মেক্সিকো (১২ মিলিয়ন) ও রাশিয়া (১১ মিলিয়ন)। তবে ভারত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অভিবাসন গ্রহণ করলেও এখানে প্রায় এক বিলিয়ন লোকের বাস থাকায় ভারত থেকে অভিবাসনের হার অন্য দেশের তুলনায় খুব কম। মাত্র ১% ভারতে জন্মগ্রহণ করা মানুষ অভিবাসনে যায়, যেটার হার যুক্তরাষ্ট্রের সমান। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতে এসে অভিবাসন গ্রহণ করার আগ্রহও রয়েছে প্রচুর। যে ২০টি দেশ অভিবাসী গ্রহণ করে ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম এবং তার স্থান ১২-তে। ভারতে ইমিগ্র্যান্টের সংখ্যা ৫.২ মিলিয়ন। ভারতে যারা অভিবাসন গ্রহণ করে তারা আশপাশের দেশ থেকে সাধারণত আসেন। প্রবাস থেকে ভারতীয়দের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ সব দেশের ওপরে, যা তাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটায়। ভারত, মেক্সিকো, রাশিয়া ছাড়াও বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা এবং আফ্রিকা, ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকেও প্রচুর মানুষ উন্নততর জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষায় অভিবাসনের চেষ্টায় রত।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি বসবাস করে। তাদের সংখ্যা প্রায় ১.২ মিলিয়ন। সৌদি আরব ছাড়াও আরব বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে, যেমন- সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার ও বাহরাইনে প্রচুর পরিমাণ বাংলাদেশি প্রবাসী বসবাস করেন। যুক্তরাষ্ট্রেও আনুমানিক দু-তিন লাখ বাংলাদেশি রয়েছেন। যুক্তরাজ্যের ২০০৯ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ৫০০,০০০ (অধিকাংশ-ই সিলেটি) বাংলাদেশি বসবাস করেন। ব্রিটেন ও ইতালিতে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ই বৃহত্তম অভিবাসী সম্প্রদায়। প্রবাসে বসবাসরত এক কোটি তিরিশ লাখ বাংলাদেশি ২০১২ সালে ১৩.৯ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। ২০১৭-১৮ সালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলার। এ বছরের শুরুতেই বাংলাদেশ নতুন রেকর্ড গড়েছে। ২০২০-এর প্রথম ১৫ দিনে (জানুয়ারি ১, ২০২০ থেকে জানুয়ারি ১৫, ২০২০ পর্যন্ত) রেমিট্যান্সের পরিমাণ হয়েছে এক বিলিয়ন ডলার।

অভিবাসনের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লোকজন গ্রহণ করে আমেরিকা (৪৬%)। এরপর রাশিয়া (১২%), জার্মানি (১২%), সৌদি আরব (১০%), যুক্তরাজ্য (৯%), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৮%)। বাকি অভিবাসীরা যান কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, ভারত ও অন্যান্য দেশে।

২০১২ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীর সব নাগরিককে যদি যার যার খুশিমতো যে কোনো দেশে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার বৈধ ভিসা দেওয়া যেত তাহলে ৬৪০ মিলিয়ন মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে অভিবাসন নিত অন্য কোনো দেশে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে ২৩% লোক যেতে চায় স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য। দ্বিতীয় জনপ্রিয় দেশ যুক্তরাজ্য, যেখানে ৭% মানুষ যেতে চায়। এছাড়া আর যেসব দেশে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে লোকজন সেই দেশগুলো হলো কানাডা, ফ্রান্স, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি ও স্পেন।

কোনো বিশেষ শাসনামলে কোনো কোনো শ্রেণির বিদেশে পলায়ন বা প্রস্থান : ধর্মীয় বা রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্যের জন্য কোনো কোনো শাসনামলে কোনো কোনো বিশেষ শ্রেণি বা ব্যক্তিসত্তা স্বস্তি বোধ না করায় দেশান্তরী হয়। এছাড়া সরকার কর্তৃক কাউকে কাউকে নির্বাসনে পাঠানো হয় চলমান রাজনীতি বা সামাজিক অবস্থার সমালোচনা করার শাস্তি হিসেবে। কেউ কেউ অন্য স্থানে চলে যান প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভিটেমাটি জলমগ্ন বা ধূলিসাৎ হয়ে পড়ায়, কেউ যান আপন ধর্মচর্চায় সরকার বা কোনো শক্তিশালী দলের হস্তক্ষেপ বা বাধাদানের কারণে। ইসলামিক শাসনামলে ইরানের পার্সি সম্প্রদায়, আরবের ইহুদি সম্প্রদায়, মিসরের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, কুর্দিস্তানের ইয়াজিদী সম্প্রদায়ের বেশ কিছু লোক দেশান্তরী হয়। প্রাচীন বাংলায় সেন হিন্দু ব্রাহ্মণরা (বল্লাল সেন অন্যতম) পাল রাজাদের হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে ও ১২৬ বছর বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তাঁরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে এবং সৃষ্টি করে বর্ণবাদী জাত প্রথা। এর জন্য সেন রাজাদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বাঁচতে দেশত্যাগ করে অসংখ্য বৌদ্ধ। সাদ্দাম হোসেনের রাজত্বকালে কুর্দিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের জন্য অনেক কুর্দিকে চলে আসতে হয়েছে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের আমলে তাঁর বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বহু দেশ থেকে, বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলো থেকে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বেশ কিছু সৎ ও পরিশ্রমী মানুষকে স্ব স্ব জন্মভূমিতে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধকালে যুদ্ধবিমুখ ছাত্রসমাজ, বিশেষ করে এই অনৈতিক যুদ্ধে জড়ানো থেকে মুক্তি পেতে অনেকে সেনাবাহিনীতে যোগ না দিয়ে কারাবরণের সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে ইদি আমিন উগান্ডা থেকে যেমন করে উৎখাত করেছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাসরত জনগণকে, সেই ভারতীয় উত্তরসূরিদের দেশত্যাগের ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে। মানবাধিকার রক্ষা ও শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত নেত্রী আং সান সু চি ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও যেভাবে রোহিঙ্গা জনগণকে দেশ (মিয়ানমার) ছাড়তে বাধ্য করা হয়, সেটা বাস্তবিকই অমানবিক।

ডায়াস্পোরা সাহিত্য

দেশত্যাগী বা নির্বাসিত লেখক-কবি-শিল্পীরা আজ পৃথিবী কাঁপিয়ে দিচ্ছে তাঁদের ডায়াস্পোরা সাহিত্য দিয়ে। ফেলে আসা দিন ও দেশকে ভালোবেসে, তার স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে এসব অনাবাসী লেখকদের সাহিত্য ও শিল্পকর্ম সম্পন্ন করা হয়। বেশির ভাগ ডায়াস্পোরা লেখকদের মনোজগৎ থাকে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত, স্বদেশ ও অভিবাসী জীবনের টানাপোড়েনে। বিখ্যাত ও পরিচিত ডায়াস্পোরা লেখকেরা যেমন, সিঙ্গার, সলজেনিৎসিন, ইশিগুরো, রুশদি, নাইপল, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, নীরদ সি চৌধুরী, ভারতী মুখার্জি, অমিতাভ ঘোষ পরবাসে বসেও স্বদেশ নিয়ে অথবা মূলত স্বদেশ নিয়েই সাহিত্যকর্ম করে গেছেন।

জন্মস্থানের প্রতি টান অনুভবের ব্যাপারটা সম্ভবত শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পথ হারিয়ে ফেলা পশু, যেমন কুকুর-বিড়াল বা গরু, নিজে থেকে পথ চিনে প্রভুর ঘরে ফিরে আসার ব্যাপারটা আমরা অনেকেই শুনেছি। স্যামন মাছ, ইলিশ মাছ, মাইগ্রেটিং পাখি, আরও কত উদাহরণ চারপাশে। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা ভূজলে ফিরে আসে এই মাছ ও পাখিরা। ঠিক তেমনি বহু বছর ধরে দেশান্তরী মানুষের মনে জন্মস্থান ও জন্মমাটির প্রতি হাহাকার যতটা না দেশের প্রতি প্রেমের জন্য, তার চেয়ে ও বেশি নাড়ির টান, স্মৃতি রোমন্থন, নস্টালজিয়ার জন্য, যদিও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলেছেন-

‘স্বদেশের প্রেম যত সেই মাত্র অবগত

বিদেশেতে অধিবাস যার।’

প্রাচীন মহাকাব্যে (মহাভারত) আছে- যুধিষ্ঠির বকরাক্ষসরূপী ধর্মকে বলেছিলেন, ‘প্রবাসীর চেয়ে অসুখী আর কেউ নয়।’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের অল্প বয়সে বিদেশ ও ইংরেজিপ্রীতি এবং শেষ বয়সে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন এবং নতুন করে ‘তব ভাণ্ডারে বিবিধ রতন’ আবিস্কারের কথা সব বাঙালিরই জানা। এছাড়া দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কথা ও সুরে ‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি’ কিংবা ‘জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে মরি যেন এই দেশে’র মতো নস্টালজিক গানও সবার শোনা। বহুকাল ধরে প্রবাসী, প্রথমে ইউরোপে, পরে আমেরিকায়, বিখ্যাত বাঙালি কবি শহীদ কাদরী জীবনের শেষ কয়েক দশক স্বদেশে ফেরেননি। মৃত্যুর কিছুকাল আগে এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে দুঃখ করতে দেখা যায় এই বলে যে, ‘বিদেশ কখনোই কারও আপন হয় না।’ শহীদ কাদরী তাঁর ‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয়’ কবিতাটিতে লিখেছিলেন… ‘এক অনন্ত অচেনা পরিবেশ। ভিন্ন পরিবেশ কখনোই আপন হয় না।’ স্বদেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও অর্ধশতক ধরে আমেরিকা প্রবাসী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত তাঁর অনুপম গ্রন্থ ‘স্বদেশ দূরদেশ’-এ লিখেছেন, গৃহত্যাগী, দেশান্তরী মানুষকে ‘চলে আসার সময় বারবার তাকিয়ে পেছনের দৃশ্যাবলি হৃদয়ে তুলে নিতে হয়। যেন কখনো ঝাপসা হয়ে না যায়।’

আমি নিজে ‘আজন্ম পরবাসী’ ও ‘অবিনাশী যাত্রা’ নামে দুটি গল্প লিখেছি তাদের নিয়ে, যাদের মর্মযাতনার কাহিনি খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে আমার, যারা একান্ত অনিচ্ছায় এবং বাধ্য হয়ে স্বদেশ ত্যাগ করেছিল। ‘অবিনাশী যাত্রা’ গল্পে তাই কথক নারীকে বারবার কবিতা বা পালাগানের মতো একই কথা ঘুরেফিরে উচ্চারণ করতে দেখা যায়, ‘বানের জলে ভেসে আসিনি আমি। তবে নৌকা করে সাগর পাড়ি দিয়েছিলাম। আমারও ঘর ছিল। দোর ছিল। ছিল লোহার শিকের জানালা। ঘরের ভেতরে ছিল বুড়ো মা-বাবা। দুলাল। আজ কেউ নেই। কিছু নেই। তবু সেখানেই ফিরে যাচ্ছি।’

অথবা যশোরের এক অঞ্চল, নেহায়েৎ পরিহাসের মতো শোনালেও যার নাম ‘বাড়িখালি’, সেখানকার এক লোমহর্ষক ঘটনা সংবাদপত্রে পড়ে লিখেছিলাম :

বাড়িখালি

সালটা দু’ হাজার ষোল
মাসটা এপ্রিল।
জায়গাটা বাড়িখালি
জেলা যশোহর।

যশোরের বাড়িখালি।

তিরিশ জনের বাড়ি খালি.

কিন্তু ক্যান্‌?

শাহীন চেয়ারম্যান।

ঘর ছেড়ে সব বনে গেছে ভাই

বাড়িখালির তিরিশ বাড়ি খালি আছে তাই।

সন্ধ্যা নামে; ধীরে ধীরে রাত্রি যৌবনবতী হয়

শেয়াল কিংবা তক্ষক ডাকে আশেপাশে;

ভুতুম প্যাঁচারা ঝিমোয় ডালে বসে।

অনড় বাড়িখালি নিঝুম দাঁড়িয়ে রয়।

জোনাকী পোকারা জ্বলে আবছা অন্ধকারে

শূন্য ঘরের খোলা দরজায় বাতাস কড়া নাড়ে,

অস্পষ্ট এক গোঙানির শব্দ কানে ভেসে আসে,

“আমরা এখানে ছিলাম। বিতাড়িত গত মাসে।’

ডায়াস্পোরা লেখক বা সাধারণ জনগণ নয়া বাসস্থানের যাপিত জীবনে অবারিত সাজ-সরঞ্জাম এবং অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা যতই ভোগ করুন না কেন, অন্তরে সর্বদা স্বদেশের প্রতিচ্ছায়া ধারণ করে থাকেন, সব সময়েই স্বদেশের পথঘাট, লোকজন, বহুবিধ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি রোমন্থন করে সময় কাটান। বড় বড় অনেক ডায়াস্পোরা লেখক, কবি স্বদেশ বিহনে অশান্তি ও অস্বস্তিতে জীবন কাটিয়ে কেউ কেউ, যেমন সলজেনিৎসিন (সোভিয়েত সরকার দ্বারা নির্বাসিত), শেষ বয়সে যখনই সুযোগ এসেছে, সময় ও রাজত্ব পাল্টিয়েছে (সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছে), তখনই সব ছেড়েছুড়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন, যেরকম করে প্যাসিফিক মহাসাগর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে স্যামন মাছ; তীব্র গতিতে ফিরে চলে তার জন্মনদীর খোঁজে। জীবিত অবস্থায় না পারলে অভিবাসী বাঙালি বলে যান তার মৃতদেহটিকে বাংলার মাটিতে ফিরিয়ে নিতে। তাই তো অনেকে বহু বছর দেশে ফিরে না গেলেও জীবনের শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করেন, স্বদেশের মাটিতেই যেন তাঁর শেষ শয্যা বা অনন্ত নিদ্রা ঘটে। আর তা না হলে অন্তত তাঁর শবদেহ যেন ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে সেই ফেলে আসা দেশের মাটিতেই বিলীন হতে দেওয়া হয়।