নব্বই দশকের কোনো এক মনখারাপ কাল। সন্ধ্যা ৭টা। এখন দাঁড়ালে লোকের নজরে পড়বে না। সাড়ে ৭টা; এখন কি কলিং বেলে টিপ দেয়া যায়? তমালের মাথার ভেতরে কোষে কোষে শব্দবন্ধুরা কথা বলছে… ‘সেই বালিশে এখনো তার গন্ধ লেগে আছে, দাঁত হারানো চিরুনিটায় চুল জড়িয়ে আছে…।’ রাত ৯টা। এই সময়ে কোনো ভদ্রলোকের বাড়িতে বিনা দাওয়াতে যাওয়া যায় না। কাজেই আজও হলো না।
আজ নিয়ে তিন দিন এভাবে ফিরে যেতে হচ্ছে। উত্তরা ৬ থেকে ধানমন্ডি ২, এতখানি দূরত্বও অনায়াসে পার করা যায়, বাড়ির সামনে থেকে কলিংবেল অব্দি ৫ মিটার দূরত্ব অনতিক্রম্য হয়ে যায়। কী বলবে ? কেন এসেছে?
প্রাক্তন প্রেমিকার শ্বশুরবাড়িতে বখাটেরা যায়। হুমকি দিতে, চিঠি-ছবি নিয়ে। তমাল বখাটে না।
মোটামুটি ভদ্র ছেলের তকমা তার আছে। তবুও। মিতুর বাড়ির সামনে দাঁড়ানোর অভ্যাসটা তার ৫ বছরের। মন ভালো নেই, মন্দ নেই সব সময়েই মিতুর ঘর বরাবর দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে তার অদ্ভুত ভালো লাগত। তবে নিরাপদ দূরত্বে।
কী করা? মিতুর বাসায় মিতু ল্যান্ডফোন ধরে না, ধরতে পারে না। প্যাসেজে কমন প্লেসে ফোন রাখা। বাড়ির মেয়েদের সেটা ধরতে নেই।
বৃষ্টির রাতে বারবার মনে হতো এই বোধহয় মিতু ঘুম ভেঙে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে, নেড়ে দেওয়া পেঁয়াজ রঙা কামিজ তুলতে বের হবে। তার লম্বা চুল শুকিয়ে ভিজে যাওয়া তোয়ালেটা সরিয়ে নেবে।
মিতু বের হয় না। বৃষ্টির ফোঁটায় একাকার হয়ে চোখের লোনা জলে ভিজে কাঁপতে কাঁপতে তমালের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘তোমার ঘুম এত গাঢ় কেন মিতু?’
মিতুদের সেই টানা বারান্দাটার পলেস্তেরা খসা রেলিংয়ের বাঁকগুলো আর দেয়ালের রং ওঠা প্রতিটা খাঁজ সাক্ষী, সাক্ষী ফাটলে বেড়ে ওঠা ফার্নটা, সাক্ষী অকালে ডাকা কাকটাও। শুধু মিতুই সাক্ষী না।
দ্বৈত প্রেমের দিনগুলোতেও মিতু এসব কথা উড়িয়ে দিত। তমালের কিছু এসে যায়নি। দামাল প্রেমিক প্রমাণের চেষ্টায় সে দাঁড়াতো না। সেই বাসাটায় মিতু থাকতো, সেখানে দাঁড়াতে তার ভালো লাগতো, এতগুলো বছর ধরে এতখানি ভালো লাগা দেবার জন্যই সে মিতুর কাছে কৃতজ্ঞ।
ট্রেতে করে রং চা, শুকনো বিস্কিট আর কাটা আপেল নিয়ে মিতু এলো। বাড়ির আভিজাত্য বনাম নাশতার মালিন্য বলে দেয় সে এখানে কতটা অবাঞ্ছিত।
কলিংবেলে দরজা খুলেছিল বাড়ির চাকর গোছের কেউ। ভেতরে গিয়ে এসে বসতে বলে চলে গেছে। মিতু তমালের নাম শুনেই হয়তো রুম থেকে বেরিয়ে এসে তমালকে ভেতরে বসাবার ভদ্রতাটাও করেনি। প্রায় আধাঘণ্টা বসিয়ে রেখে একবারে ট্রে নিয়েই ঢুকেছে। চাকর গোছের মানুষটাকে হয়তো কোথাও সরিয়ে দিয়ে থাকবে, বিব্রত হওয়া থেকে বাঁচতে। মিতু বরাবর বাস্তববাদী। এবং বুদ্ধিমতী।
টি টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে মিতু টানটান হয়ে অসহিষ্ণুভাবে বসলো।
যার তর্জমা :দ্রুত কী বলতে এসেছ বলো, আমাকে দেখতে এসে থাকলে দেখে, চা বিস্কিট দাঁতে কেটে বিদেয় হও।
-তোমার স্বামী?
মিতুর শক্ত মুখচোখে ভ্রু কুঁচকে গেল। মিতুর ভ্রু তমালের সামনে ঘনঘন কুঁচকে যেত। একটা সময় তমাল এতে খুব তটস্থ থাকতো। কুঁচকানো ভ্রু সোজা করার আশায় উতলা হতো। আজ তার আর কিছুই এসে যায় না। খুব সহজেই তমাল আজ মিতুর এই চেহারা উপেক্ষা করতে পারলো। সাদাকালো যুগে নেতিবাচক চরিত্রের মহিলাদের দেখতে কুটিল হতে হতো। আজকের যুগে তারা বেশ সুন্দরীই হয়। সাপের মতো হিসহিসিয়ে কথা বলে। মিতুও ঠিক সেভাবে বলল :
– আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে এসেছ? সব বলে দেবে? চিঠি দেখাবে, তাই তো?
তমালের খুব আমোদ হলো। অতি বুদ্ধিমান মানুষগুলো আশপাশের সবাইকে এত ছাগল কেন ভাবে? সবাই ঘাস খায়? মিতুর মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে এসবের প্রস্তুতি না নিয়ে বিয়ে করেছে? তাহলে কি তমালকে সে আজ ঢুকতে দিত? চিনতেই কি অস্বীকার করতো না?
আচ্ছা, মিতুর বর কি মিতুর চেয়েও বুদ্ধিমান? তমাল যতদূর জেনেছে তাতে বুদ্ধি কিংবা চতুরতায় কোনো ঘাটতি নেই। কী টানটান উত্তেজনার সংসার এমন মানুষদের! ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ।
কাফ লিঙ্ক খুলে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ড্রইংরুমে ঢুকলেন। অফিসের জামা ছাড়েননি এখনো! নাকি তমালকে তার অতি দামি ব্র্যান্ডেড শার্ট, দামি শুটের প্যান্ট দেখাতে চেয়েছেন? হাতঘড়িটাও! বৃদ্ধাঙ্গুলে অনামিকার প্লাটিনামে বসানো ডায়মন্ড রিংটার ঘূর্ণনের দিকে তাকিয়েই হয়তো মিতুও তার ফাইল করা পালিশ দেয়া চকচকে আঙুল নাচিয়ে তার গহনাপত্তর, দামি আঁচল নজরে আনছে।
কিংবা, হয়তো সবই রানার হীনম্মন্যতার কাছেই এমন হয়ে ধরা পড়ছে। মিতু এমন হাত-পা নাচিয়েই তো কথা বলতো! তখন তো কোনোদিন খেয়াল হয়নি ওর হাতে কোনো গয়না ছিল কিনা! শুধু গলার একটা চেইন মনে পড়ে, জামার চেইনে বারবার আটকে যেত। মিতু বিরক্তসুলভ আওয়াজ তুলে বলতো,
– একটা চেইনও …।
– কোথায় আছেন ?
– মিতুর বরের প্রশ্নের জবাবে বোকা বোকা উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো, ‘জি? এই মুহূর্তে তো আপনাদের বাসায়। এল্ফিম্নতে বান্দরবান থাকি।’
– ভদ্রলোক খুব ভালো করেই তমাল সম্পর্কে জানে। সে তাদের সম্পর্কের গভীরতা মেপেই বিয়ে করেছে। এবং মিতুও এনগেজমেন্টের আংটি লুকিয়েও তমালের সাথে দেখা করেছে, তমালের সাথে সম্পর্ক লুকিয়ে হবু বরের বিলাসী গাড়িতে দামি রেস্তোরাঁয় আভিজাত্য মেখেছে। কে বলে দুই নৌকায় পা রেখে চলা যায় না!
– তমাল টিপিকাল নাটক-সিনেমার মতো কি বলতে পারতো, ‘মিতুর বিয়েতে আসতে পারিনি। তাই দেখা করতে এলাম। ওর যা কিছু আমার কাছে ছিল ফিরিয়ে দিতে এলাম …।’
ব্যাকগ্রাউন্ডে তীব্র ক্লাইমেক্স মিউজিক বাজতো।
নাহ্। সে এত নাটুকে না। সে এত হিসাব করে ভালোবাসেনি। কিন্তু ভীষণ এলোমেলো। সে আজ গুছিয়ে এসেছে। দু’জন বুদ্ধিমান মানুষের বাড়ি এসে একা মোকাবিলা করতে তাকে হোমওয়ার্ক করেই আসতে হয়েছে।
দেয়ালে ঝুলানো মিতুর শশুর?-শাশুড়ির ছবি। বয়সকালে হরমোনের মাতলামি যখন স্থির হয়ে আসে, দু’জন মানুষের অপশন কমে আসে, একে অপরের কথা বলার, মুখের ওষুধ-পানি এগিয়ে দেবার, টয়লেটে পড়ে গেলে তুলে দাঁড় করাবার সহায় হয়- তখনই হয়তো এত গভীর চোখে নিখাদ পরম নির্ভরতায় একে অন্যের দিকে তাকায় মানুষ। একে সেই সত্যিকারের ‘ভালোবাসা’ কি বলা যায়? ভালোবাসা আর সম্পর্ক হলো নেশা (passion) আর পেশার (profession) মতো। খুব কম মানুষই যেমন তার নেশাকে পেশাতে পরিণত করতে পারে, তেমন খুব কম মানুষই জন্ম- জন্মাতরের সম্পর্কের জন্য বা বিয়ের ভাবনাতেই প্রেম করে। স্রেফ প্রেম করতে হয়, সময়ের দাবি- তাই করে। তাই প্রেম পরিণতি পায় না, পায় কবিতা লেখার উছিলা।
কিন্তু তমাল তার টগবগে তারুণ্যের সবটুকু রোদ দিয়েই একজনকে ভালোবেসেছিল, যাবজ্জীবনের হলফনামাতেই। সেই হলফনামা মিতুর স্বাক্ষরবিহীন রয়ে গেল।
– জি আমি এখনো ঢাকায় আছি। সামনের সপ্তাহ থেকে বান্দরবান পোস্টিং। হিল পোস্টিংয়ে অ্যালাউন্সটা ভালো। আগে এড়িয়ে গিয়েছি। এখন আর এড়ানোর কারণ নেই। আপনাদের বিয়েতে গিয়েছিলাম তো। কাচ্চিটা খুব ভালো হয়েছিল, পায়েসটাও। দেখা করিনি,… কারণ তখন অভিনন্দন দিলে আপনারা ভাবতেন মনভাঙা স্যাড প্রেমিক, করুণা! ইশ আহ ! ব্যাপারটা ভুল হতো।
– ভুল?
– মিতু আর তার বর হিসাব করেই উঠতে পারছে না সে বিয়েতে গিয়েছিল- এই তথ্য তারা জানলো না কী করে।
– হ্যাঁ ভুল তো! আমি সত্যিই খুব খুশি যে মিতু ওর সুযোগ্য বর পেয়েছে। না-না, এজন্য না যে আপনি এই এই সেই…। এজন্য যে আপনারা একদম অভিন্ন চরিত্রের! একজন মানুষ কারো সাথে সম্পর্কে থাকা অবস্থায় তাকে প্রতারণা করেছে শুধু ট্রাই করার জন্য যে বেটার অপশন পাওয়া যায় নাকি, না পেলে ফিরে আসা যাবে! আর আরেকজনও এমন যে এক মানুষের তীব্র সম্পর্কে থাকা ‘অন্য নারী’র দিকেই হাত বাড়ায় ! এত মহান প্রেমিক হতে সিংহহৃদয় লাগে ! অনেক বড় প্রেমিক আপনি। বন্ধুমহলে, করপোরেট পাড়ায়- জানি! আমি তো কিছুতেই মিতুর যোগ্য ছিলাম না! সত্যিই আন্তরিকভাবে অভিনন্দন দিতেই এসেছিলাম, সেটা সেদিন বলা যেত না।
যাই। আর কোনোদিন দেখা হবে না; অন্তত আমি তাই আশা করি।
-আগুপিছু না ভেবে হড়বড় করে কথাগুলো উগরে দিয়ে রাস্তায় পা দিয়ে মনে হলো একটা ছোট ভুল হয়ে গেছে। আর দশজনের মতোই সে তার ভালোবাসার মানুষের বদলে মানুষটার যে দখল পেয়েছে তার ওপর ঝাল ঝেড়েছে বেশি। এই অধিকার তো তার ছিল না!
তবু এই কথাগুলো না বলতে পারলে আজ পাথর চাপা থাকতো। পরাজয় নেয়া যায়, সব হারানোর কষ্টও সয়ে যায়, প্রতারণা না, ব্যবহার হওয়া না।
একজন মানুষ যখন ভালো থাকা, মন্দ থাকার সব উপাত্ত হয়ে যায়, তখন সে চলে যাবার চেয়েও দুঃসহ হয় সে পচে যাওয়ার। পচা ঘা বুকে রাখবে না। একটা দিন তার এমন আসবে যেদিন আজকের দিনে এমন কেঁদেছিল, এমন বুক ভাসা জলে ভেসেছিল ভেবে অবাক হবে। মানুষ এমন আঘাতে এটা মনে রাখতে পারে না বলেই মৃত্যু বা বখে যাওয়াকে ভালোবাসার প্রতিশব্দ বানায়।
আচ্ছা, মিতুকে লেখা শেষ চিঠিটাও কি মিতু পুড়িয়ে ফেলেছে ?
…মিতু,
সামান্য কিছু সম্পদ আমার, তোমার কাছেই বন্ধক ছিল
শ্রাবণের কিছু মেঘভেজা দিন, চিঠিতে মোড়ানো রাতগুলো ছিল।
চিতায় সবটা পুড়িয়ে নিও
বন্ধকিটুকু ফিরিয়ে দিও।