অধ্যাপক সায়ীদের লেখায় কোথাও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়নি বরং নারীর সৌন্দর্য প্রকাশের অতিরঞ্জন দেখেছি।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের শাড়ি বিষয়ক লেখাটি পড়লাম, বারবার পড়লাম। বাঙালি মেয়েদের শাড়ি সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ শালীন পোশাক, শরীরকে যতটুকু অনাবৃত রাখলে তা সবচেয়ে রহস্যচকিত হয়ে উঠে, শাড়ি তারই উপমা। যৌনাবেদনপূর্ণ অনুভূতি মানব মনের মৌলিক, শাশ্বত, প্রকৃতজ, স্বাভাবিক, সুপ্ত, অন্তর্নিহিত, নিগূঢ় ও সুস্থ এক ভালোবাসার অনুভূতি। এখানে শালীনতা অশালীনতার প্রশ্ন অবান্তর। বেশীরভাগ সমালোচকই শাড়িকে যৌনাবেদনপূর্ণ শালীন পোশাক বলায় আহত হয়েছেন, মানসপটে যৌন উত্তেজক কিছু কল্পনা করেছেন, তাদের চোখে লেখকের যৌনাকাঙ্খা ফুটে উঠেছে।
কিছু সমালোচক সরাসরি অধ্যাপক সায়ীদকে সেক্সিস্ট অভিহিত করেছেন। আমার ধারণা এরা সেক্সিস্ট শব্দটা যথাযথ প্রয়োগ করেননি। সমালোচনার বিষয়বস্তু পড়লে মনে হয় sexually perverted বলতে গিয়ে তারা সেক্সিস্ট বলেছেন। সেক্সিস্ট (sexist) একটা ইংরেজি শব্দ, যেসব মানুষের আচরণে বিপরীতলিঙ্গের প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয় তাদেরকে সেক্সিস্ট নামে অভিহিত করা হয়। অধ্যাপক সায়ীদের লেখায় কোথাও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়নি বরং নারীর সৌন্দর্য প্রকাশের অতিরঞ্জন দেখেছি।
নারীর প্রতি প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা ও শ্রদ্ধাবোধের বহিঃপ্রকাশ থেকেই সৌন্দর্যের প্রকাশ, বর্ণনা। ডাগর ডাগর চোখ, আঙ্গুর লতার মত দেহ, দুধে আলতা রঙ, দীঘল গড়ন, চাঁপাকলির মত আঙ্গুল, ক্ষীণকটি, দীঘল কালো চুল, লাউয়ের ডগার মত দেহবল্লরী, বাঁশির মত নাক, মরাল গ্রীবা, কমলার কোয়ার মত ঠোঁট, এসবই বাংলা ভাষার মাধুর্য, নারী দেহের শৈল্পিক বর্ণনা। কোনো অশ্লীলতা নেই। দেখাটা সম্পূর্ণ বোধের ব্যাপার, সৌন্দর্যের বর্ণনায় যৌনতা খোঁজা একটা রোগ, মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন : শাড়ি কথন: ঘটন-অঘটন!
আধুনিক ও মধ্যযুগের বেশীরভাগ কবি সাহিত্যিকরাই নারীদেহকে সৌন্দর্যের উপমা হিসেবে প্রকাশ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের উচ্চশিক্ষিতরা রাধার রূপের বর্ণনা, তার নিখুঁত স্তনের বর্ণনা, ‘যুগল গিরি’, ‘অতিশয় মাজা ক্ষীণী’, ‘গুরুয়া নিতম্বিনী’, এসব শব্দ যথাযথ ভাবে আত্মস্থ করেই ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
মানবদেহের কোন অংশই লজ্জার অঙ্গ নয়। তবে যেসব অঙ্গ সরাসরি যৌনতা সম্পৃক্ত, তা ঢেকে রাখা শালীনতার অংশ, তবে ইউরোপ আমেরিকা আর সৌদিআরব আফগানিস্তানে এই সংজ্ঞার ভিন্নতা রয়েছে। অবশ্য এই ঢেকে রাখাও রহস্যচকিত। অধ্যাপক সায়ীদের মতো আমারও মনে হয়, শাড়ি বাঙালি মেয়েদের শালীনতা আর অশালীনতার বিভাজনে, রূপ মাধুর্য প্রকাশে সবচেয়ে রহস্যচকিত পোশাক। বাঙালী নারীরা সবচেয়ে বেশি বিকশিত, উন্মিলিত ও লাবণ্যময়ী হয় এই শাড়ীতে, এ যেন স্বর্গলোক থেকে নেমে আসা পরী, সুন্দরের দেবী আফ্রোদিতি।
সর্বশেষে, শালীনতা অশালীনতা সম্পূর্ণই বোধের ব্যাপার, আপনি কীভাবে দেখছেন, সেটাই মুখ্য। সুন্দরের মাঝে অশ্লীলতা, নগ্নতা খোঁজাও এক প্রকার নগ্নতা, মনের দৈন্য। অধ্যাপক আবু সায়ীদ কোনো অশ্লীল শব্দ লিখেননি, নারীকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করে চেটে খেতে চাননি। সমস্যা হলো, সমান্তরাল রেখায় কোনো চিত্রকর্ম হয় না, রেখার বিন্যাস আঁকি-বুকি থাকবেই। সুরের ওঠানামা না থাকলে সংগীত হয় না। মানবদেহও তেমনি, বাঁক থাকবে, উঁচুনিচু বিভাজন থাকবে, মাধুর্য থাকবে, বলিষ্ঠতা থাকবে, তবেইতো সৌন্দর্য পরিস্ফুটিত হবে, লেখকের লেখনিতে তা প্রকাশিত হবে।
লেখক জাফিরুল হোসাইন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের সাউথ ইস্টার্ন সিডনি লোকাল হেলথ ডিস্ট্রিক্ট এর সিনিয়র এনালিস্ট।