স্কুলে পড়বার সময়েই আমার ভালো লাগল এক ডোমের মেয়েকে। সেই ভাল্লাগা টেকসই হলো না। কিছুদিন পর একদিন ভালো লাগল এক বেদেনীকে। সে-সময় খুব মনে হতো, আমাদের বাড়ির লোকেরা ঝামেলা না করলে আমি কোনো ডোমনিকে ভালোবেসে যাব কিম্বা যদি পারি, ভরাট দিঘির মতো বেদেনীকে না-হয় তার মেয়েকে নিয়ে সংসার করব। দেখেছি (এখনো দেখে যাচ্ছি) তাদের কালো, ছিপছিপে পেটানো শরীর। মনে মনে ভাবতাম, লোকালয়ে সারাদিন সাপখেলা দেখিয়ে আমার বেদেনী কোমর দুলিয়ে ঘরে ফিরবে। ঘর বলতে চরাঞ্চলে বাঁধা ছোট খুপরি হতে পারে। সবসময় বেদেবহরের ভ্রমণশীল জীবনও আমার পছন্দ ছিল। আমারও একটা বেদেজীবন হবে- এরকম বিভোরতা ছিল। ধরো, আমার বেদেনী নাকফুল ছাড়া থাকতই না, বেদেনী যখন আমার দিকে তাকাত, আমি ভাবতে পারতাম, সে সাপ খেলা দেখাবে, আমি তার বশে আছি জেনেও সে ঝাঁপি থেকে একটি গোখরা বের করে বলত, ‘ওইটা শত্রু, তারপরও সারারাত ও আমার বুকের উপর শুয়ে থাকে, দে, ছোবল দে।’ সাপ বুঝে ফেলত ব্যাপারটা, সাপ লজ্জা পেয়ে ফের ঝাঁপিতে ঢুকে পড়ছে দেখার পর আমার বেদেনী বউ তার আসল চেহারা মেলে ধরে বলত, ‘সাপ লজ্জা পাইতে পারে, ভয় পাইতে পারে, আমি পাই না, আমিই ছোবল দেব এইবার।’ আবেশে আমার মাথাটা বেদেনীর কোলের মধ্যে আরো ঠেলে দিয়ে বলতাম, ‘দাও, যত খুশি দাও, আমাকে ছোবলে ছোবলে রক্তাক্ত করে দাও, আমার জিব্বায় বিষ ঢেলে দাও, আমি সারারাত মরে পড়ে থাকব কবরের মধ্যে, সারারাত তুমিই আমার কবর, বেদেনী।’ ভোরবেলা, বেদেনী বেরিয়ে পড়বে গ্রামে, গঞ্জে আর আমি কবিতা লিখতে বসব। এরকম কি হয়, হতে পারে? এটা প্রায় দেখাই যায় না যে, বেদেপল্লির কেউ কবিতা লিখছে। আমিই না হয় লিখতাম আমাদের অনাধুনিক জীবনের ভালোবাসার কথা। ভালোবাসার কথাগুলোই তো কবিতা হয়ে যায়, ভালোবাসার বাঞ্ছাগুলোই তো পাঠকের সঙ্গে কবিকে একটা সাঁকোর উপরে দাঁড় করিয়ে দেয়।

হতে পারে, ভালোবাসা আধুনিক কবিকে পুঁটিমাছ বানিয়ে দেয়। কবিকে জ্বলন্ত চুলায় কড়াইয়ের গরম তেলে ভাজি ভাজি হতে হয়। তারপর সুস্বাদু লাগে ভাজা পুঁটিমাছ কিম্বা কবিতা। কবিতারা ছাপা হয় কাগজে কাগজে, কাগজ পৌঁছে যায় ভোরবেলা তোমাদের বাসায়। তুমি সেই কবিতাকে পড়ো আর নাই পড়ো, বাইরে রোদ বাড়তে থাকে, রোদ দুপুর হয়ে দাঁড়ায়। এরকম গনগনে দুপুরে আমি সন্ধান করি কবিতার, ভালোবাসার। কিন্তু ভালোবাসা কি সন্ধান করে পাওয়া যায়? ভালোবাসা কি দোকানের চকলেট, যত্রতত্র কিনতে পাওয়া যায়? যাক না যাক, চোখের সামনে বসন্ত চলে আসে। কোকিলের ডাক খলবল করতে থাকে বুকের ভেতর। সবসময়ই মনে হতে থাকে, কী নেই, কী যেন নেই! খর্খরে হাওয়ার মধ্যে পড়ে গিয়ে একটা ছ্যারাভেরা দশা। মনে হতে থাকে সেই বেদেকন্যার নাকফুল, তার ছিপছিপে শরীরের বাঁক। কবিতাও বাঁক নিতে থাকে। বাঁকের কবিতা লেখার সম্ভাবনায় দুপুরের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমিও তখন দুপুর হয়ে উঠি। হঠাৎ একটা ঘূর্ণি আসে, আমি ঘূর্ণির দিকে ছুটি। ঘূর্ণিতে ওড়ে ধুলোবালি খড়কুটো- ছুটতে ছুটতেই পেয়ে যাই আমি বোরাকের ডানা দুটো, যেন-বা আমিও উড়তে পারি গগনডাঙার দিকে-

ভালোবাসার মধ্যে অপেক্ষা করো, উড়তে উড়তেই আমি ভালোবাসার কবিতা নিইয়ে আসছি লিখে।