দুই প্রজন্মের চিত্রকলা

নিজের জীবনের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা অনেক পিতাই তার সন্তানদের ভেতর দিয়ে পূর্ণ করতে চান। আবার পিতার অসমাপ্ত কর্মকে নিজের জীবনে ধারণ করে সন্তানের অনন্য মাত্রায় পৌঁছার ঘটনাও বিরল নয়। পেশাভিত্তিক পারিবারিক পরম্পরায় নয়; সৃজনশীলতার পারিবারিক পরম্পরায়ও কোনো কোনো পরিবার প্রজন্মান্তরে সৃষ্টির ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এদিক দিয়ে নবী পরিবারের সাফল্য রীতিমতো দৃষ্টান্তমূলক। নবী পরিবারের একজন তো দেশবিখ্যাত- প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। ‘রনবী’ নামে তিনি সমধিক পরিচিত। কিন্তু এ লেখার মূল বিষয়বস্তু শিল্পী রফিকুন নবী নন, বরং তার বাবা রশিদুন নবী, যিনি কিনা শৈশবের রফিকুন নবীর প্রথম শিল্পগুরু। তবে নিজে তিনি প্রতিষ্ঠিত নন শিল্পী হিসেবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা তার ছিল না বললেই চলে। তিনি ছিলেন পুলিশ কমকর্তা। পুলিশের চাকরিটি তিনি পেয়েছিলেন তার বাবা অর্থাৎ রফিকুন নবীর দাদা মহিউদ্দিন আহমেদের পুলিশ জীবনের সূত্রে। বাবার পুলিশের চাকরির ‘কোটা’ই শুধু নয়; শিল্পরুচির সহায়তাও রশিদুন নবী পেয়েছিলেন। সেই সূত্রে রফিকুন নবী, তৌহিদুন নবী, রেজাউন নবীসহ রশিদুন নবীর ১১ সন্তানময় পরিবারে শিল্পচর্চার একটা তাগিদ সর্বদাই সঞ্চারিত ছিল। এ প্রসঙ্গে বাবা রশিদুন নবীর শিল্প প্রচেষ্টা নিয়ে পুত্র শিল্পী রফিকুন নবীর কথা- ‘তাঁর আশকারাতেই যে যার মতো নানা কিছু করতাম। আমিসহ কেউ কেউ ছবি আঁকতাম ছেলেবেলায়। কেউবা সুচারু সেলাই ফোঁড়ে মন দিত।…আমার এখন মনে হয় যে, আসলে বাবা সম্ভব হলে সবক’টি ছেলেমেয়েকেই কোনো না কোনো দিকের শিল্পী বানিয়ে ছাড়তেন।’ বানিয়েছেনও তাই। বিশেষ করে বড় ছেলে রফিকুন নবী ও পঞ্চম ছেলে রেজাউন নবী তারই প্রমাণ। এ দেশের চিত্রকলায় তাদের অবস্থান শিল্পরসিক বাবা রশিদুন নবীর সার্থকতা।

কিন্তু রশিদুন নবীকে কেবল শিল্পরসিক বলে শেষ করে দিয়ে এ যাত্রায় পার পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে পুরোদস্তুর শিল্পীই বলতে হচ্ছে সম্প্রতি চিত্রক গ্যালারিতে আয়োজিত ‘পরম্পরা’ শিরোনামের শিল্প প্রদর্শনীতে দাঁড়িয়ে। স্থান পাওয়া শিল্পীদের তালিকার ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে প্রদর্শনীকে নবী পরিবারের শিল্প প্রদর্শনী বলা যায়। প্রদর্শনীতে বাবা রশিদুন নবীর বিভিন্ন মাধ্যমের বেশ কিছু চিত্রকর্ম এবং ভাস্কর্যের সঙ্গে সন্তান রফিকুন নবী, রেজাউন নবী ও পুত্রবধূ সোহানা শাহ্‌রীনের চিত্রকর্ম যেমন আছে; স্থান পেয়েছে পুত্র তৌহিদুন নবীর আলোকচিত্রও। বাবার শিল্পচর্চার অবশিষ্ট নিদর্শনকে উপস্থাপনের জন্যই সন্তানেরা গ্যালারি চিত্রকের আগ্রহ ও অনুরোধে আয়োজন করেছেন এ প্রদর্শনী। তাতে স্থান পেয়েছে নবী পরিবারের দুই প্রজন্মের শিল্পকলা চর্চার নিদর্শন। এবং প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে মুখ্য শিল্পী আজীবন অন্তরে শিল্পের সুষমা লালন ও পালন করা মানুষ রশিদুন নবী।

রশিদুন নবী কী এঁকেছেন জীবনে? প্রদর্শনী ও বাবার শিল্পজগৎ নিয়ে রফিকুন নবীর লেখা থেকে জানা যায়- রশিদুন নবীর অনেক ভালো ভালো কাজ হাতছাড়া হয়ে গেছে বহু আগেই। রশিদুন নবীর বাল্যকালের বিদ্যালয় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে সেখানকার ছাত্র-শিক্ষকদের আয়োজনে সত্তরের দশকে তার একটি একক শিল্প প্রদর্শনী হয়েছিল। তাতে বেশকিছু কাজ বিক্রিও হয়েছিল। সেই সঙ্গে বন্ধু-বান্ধবদের উপহার দিয়ে কিছু কাজ গেছে।

সুতরাং সাম্প্রতিককালের এ প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া কাজগুলোই রশিদুন নবীর জীবনের অবশিষ্ট কাজ। হাতছাড়া হয়ে যাওয়া ভালো ভালো কাজের কথা বাদ দিলে কেবল এ কাজগুলোকেই যদি একজন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত কিন্তু চিত্রকলা ও শিল্পের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসায় পূর্ণ একজন মানুষের আত্মচেষ্টার নিদর্শন হিসেবে যাচাই করা হয়; রশিদুন নবীকে নিঃসন্দেহে একজন উঁচুমানের শিল্পী বলা যায়। এ কথা যে কোনো শিল্পসচেতন মানুষই তার বিভিন্ন মাধ্যমের কাজগুলোকে দক্ষতা, রঙের প্রয়োগ ও পরিমিতিবোধ এমনকি স্বকীয়তায় অনন্য বলে সম্বোধন করবেন।

পুলিশ বাবার অকালমৃত্যুতেই মূলত একমাত্র ছেলে রশিদুন নবীর শিল্প শিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছার মৃত্যু ঘটেছিল। তখন বাস্তবতার চাপে সংসারের হাল ধরতে তিনি বাবার পুলিশের চাকরিতেই নিয়োজিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু মনে মনে আবার শিল্পের ভেতরে ঢুকে পড়ার বাসনাটা তার মরে যায়নি। তবে ইচ্ছা থাকলেও পরবর্তীকালে স্বাভাবিকভাবে তার আর আর্ট কলেজে ঢোকা হয়নি। তাই বলে দমে জাননি। প্রায় সন্ধ্যায় অফিস শেষে বাড়ি ফিরে তিনি ছবি আঁকায় মন দিতেন। গ্রামোফোন রেকর্ডে গান শুনতে শুনতে ছবি আঁকার সেই অভ্যাস রফিকুন নবীর অঙ্কনকর্মেও প্রভাব ফেলেছে।

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া কাজগুলোর আলোকে বলা যায়, রশিদুন নবী প্রধানত কাগজেই ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া তার প্রায় সব কাজই কাগজে করা। মিশ্র মাধ্যম, জলরং, কালির সবই কাগজে। ১১ সন্তানের পরিবারে যথারীতি স্থান সংকুলানের সংকট ছিল। ছবি আঁকার পর্যাপ্ত জায়গার ঘাটতি ছিল বলে বড় কাজ খুব একটা নেই তার। সবই ছোট ও মাঝারি আকৃতির কাগজে।

সাধারণভাবে দেখলে এবং বিশেষ করে জলরঙে রশিদুন নবীর কাজে কালোর প্রাধান্য চোখে আসে। তার জলরঙের নদীতীর, শীত, ঘোড়া, নারী, গ্রামের দৃশ্য, সাঁওতাল নারী, শীতের পাখি, স্থির চিত্র ইত্যাদি ছবিতে কালো রঙের আধিক্য আছে, যা সচেতন প্রয়োগের মাধ্যমেই শিল্পীর চিত্রপ্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যকে স্পষ্ট করে তুলেছে। তিনি বাংলার গ্রাম এঁকেছেন, কিন্তু সেখানে সবুজ নেই। মাছ ধরার দৃশ্য বা নদীর তীর; সেখানেও নেই যথাযোগ্য রঙের উপস্থিতি। বরং বিপরীত রঙের মাধ্যমে সেখানে পরিচিত দৃশ্যেরই ভিন্ন চিত্ররূপ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তবে উল্টো উদাহরণও আছে। সুন্দরবন, পাখি এমন শিরোনামের কাজে রঙের ভিন্ন প্রয়োগও চোখে পড়ে। তবে সবখানেই কালো রঙের প্রাবল্য চিত্রকর্মের মূল সুরটিকে কালচে আভায় নির্মাণ করেছে। এ ছাড়া কালি ও জলরঙের যৌথ প্রয়োগের ছবিগুলোতেও একই প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে কাগজে আঁকা এসব চিত্রকর্মে কেমন এক ছাপচিত্রপ্রবণতা তৈরি করেছে রশিদুন নবীর রঙের মিশ্রণ ও তার প্রয়োগ। মিশ্র মাধ্যমে পাহাড়ি গ্রামের একটা ছবি তার এই নিজস্ব ধারার রঙের প্রয়োগ ও ‘ডিস্টরশন’ প্রবণতার ভেতর দিয়েই প্রচণ্ড সূক্ষ্ণতা বা বিস্তারিত বর্ণনার অনন্য দৃষ্টান্ত। আর সাঁওতাল নারীর ছবিটি তার কাজের ভিন্ন একটি বৈশিষ্ট্যকে একাই ধারণ করে রেখেছে। সেখানে ছাপচিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই কাগজে জলরঙের এ ছবিটি যেমন সাঁওতালি শরীরের স্বতন্ত্র অবয়বকে অনুপুঙ্খ প্রকাশ করছে, তেমনি বিস্তারিত বর্ণনার ভেতরেই ছবিটি যেন সংক্ষিপ্ত ধরনের। চেহারায় চোখটি শিল্পী স্পষ্ট করেননি, কিন্তু সাঁওতালি নারীর খোঁপায় গোঁজা প্রস্ম্ফুটিত ফুলটিও স্পষ্ট। তাও আবার সেই কালো রঙের ভেতর দিয়েই। নদী, নদীতে নৌকা, শীতের পাখি- এর সব ছবিই সাদা-কালো জলরঙে। আর সব ছবিই বলা যায় আধা-হুবহু, বাংলাদেশের শিল্পসমাজের ভাষায় যাকে আধা-বিমূর্ত বা প্রায় সম্পূর্ণ মূর্ত বলা যায়। মানে দৃশ্যের একেবারে হুবহু আঁকার ইচ্ছা শিল্পীর নেই।

রশিদুন নবীর মুখ-প্রতিকৃতির কথা বলতে গেলে, সেখানেও তার আত্মপ্রতিষ্ঠিত নিজস্বতার ছাপ দারুণভাবে স্পষ্ট। মুখাবয়ব অঙ্কনের মাপ-জোখ সংক্রান্ত দক্ষতার প্রশ্ন উতরেই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া তার দুটি প্রতিকৃতি ‘পোর্ট্রেট অব জিপসি’ ও ‘ম্যাডোনা’র মধ্যে প্রথমটি একলাই শিল্পীর চিত্রচর্চার দক্ষতা ও দর্শনকে বিশেষায়িত করার জন্য যথেষ্ট। ‘পোর্ট্রেট অব জিপসি’তে ছবিতে মুখাবয়ব প্রতিষ্ঠায় স্বাভাবিক রঙের সঙ্গে মুখে সবুজ রঙের ব্যবহার ছবিটিকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। আর দ্বিতীয় প্রতিকৃতিটি সন্তান কোলে এক মায়ের মুখের ছবি। অত্যন্ত পরিমিত রঙের ব্যবহারে রশিদুন নবীর ‘পোর্ট্রেট’ অঙ্কনের অনন্য উদাহরণ।

এ তো গেল একজন পুলিশ-শিল্পী রশিদুন নবীর চিত্রকর্মের কথা। তার ভাস্কর্য দক্ষতাও যে কোনো দর্শককে একজন রশিদুন নবীর শিল্পপ্রতিভায় বিমুগ্ধ করবে। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ভাস্কর রশিদুন নবীর তিনটি কাজ। ‘ওমেন’, ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ ও ‘ফিশিং বোট’। প্রথম দুটি কাদামাটির, তৃতীয়টি শোলা দিয়ে তৈরি। চিত্রকর্মের মতো ভাস্কর্যেও রশিদুন নবী নিখুঁত অবয়ব নির্মাণের বিরোধী। মাটির দুটি ভাস্কর্য যে হাজার বছরের প্রাচীন প্রত্ন ভাস্কর্যের আদলে গড়া। শরীর, মুখ কোনোটাই নিখুঁত, মসৃণ নয়। অমসৃণতাই তার ভাস্কর্যের শৃঙ্খলা যেন। সবকিছু মিলিয়ে রশিদুন নবীর কাজকে কেউ অদক্ষ কিংবা শখের শিল্পীর কাজ বলতে পারবেন না। জীবনব্যাপী আত্মপ্রচেষ্টায় নিজেকে যেমন তিনি শিল্পচর্চার অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন; তেমনি সেই শিল্পপ্রতিভার সঞ্চার ঘটিয়েছেন নিজের সন্তানদের ভেতরে। রফিকুন নবী ও রেজাউন নবী তার দুই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু প্রদর্শনীটি যেহেতু বাবার প্রতি সন্তানদের ভালোবাসার এক শিল্পতর্পণ; সমগ্র প্রদর্শনীতে তাই প্রাধান্য পেয়েছে বাবার শিল্পকর্ম। পাশাপাশি স্থান পেয়েছে রফিকুন নবীর স্বাক্ষরবাহী অসাধারণ বেশ কিছু নতুন-পুরাতন কাজ। শিল্পী রেজাউন নবীর কাজের পাশাপাশি তার স্ত্রী সোহানা শাহ্‌রীনের চিত্রকর্ম। রশিদুন নবীর আরেক পুত্র তৌহিদুন নবীর আলোকচিত্র এ প্রদর্শনীকে এই নবী পরিবারের শিল্প প্রচেষ্টার পূর্ণতা দিয়েছে।